…নিজেরই তখন মনে হচ্ছিল, যে-রাধা যন্তন্নায় পাগল হয়ে ছুটে এসেছিল সেই রাধা ঘরে ফিরছে না। এত বৃষ্টিতে পথ ভাঙতে কষ্ট হচ্ছে না, যন্তনার লেশমাত্র নেই, কোথায় যেতে হবে জেনেও উদবেগ নেই। এমন হল কি করে, ওই রাক্ষুশী কি তবে ওকে ত্যাগ করল?
ঘরে ফিরল। হারিকেনটা তেমনি জ্বলছে। ওটা তুলে নিয়ে দাওয়ায় এলো। মনোহর পাইক তখন উঠোনমুখে হয়ে ঘাড় ঝুলিয়ে ঘুমোচ্ছে। তারপরেই কি হল জানে না। ভিতর থেকে কেউ যেন ওকে বলে দিল কি করতে হবে। ও মায়ের মেয়ে, লম্পট ছিনাথ পোদ্দারের কাছে যাবে এ কখনো হতে পারে? হারিকেন হাতে দাওয়ার এদিক ওদিক দেখল। কি খুজছে জানে না। চেলা কাঠের ওপর কুড়ুলটা চোখে পড়ল। ওটা নিয়ে ঘরের চৌকাঠের এ-ধারে দুই হাঁটুর ওপর বসল।
ক’বার কুড়ুল চালিয়েছে, রাধা জানে না। হারিকেন তুলে এগিয়ে এসে দেখল, রক্তে ভেসে যাচ্ছে। হাতের কুড়ুল ছুঁড়ে উঠোনে ফেলে দিল। তোড়ের বৃষ্টিতে রক্তের দাগ থাকবে না। লণ্ঠন নিয়ে ঘরে এসে পরনের ভেজা জামা-কাপড় দেখে নিল। না, কুড়ুল বলেই ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটেনি বা ওর জামা কাপড়ে লাগেনি।
এখন কি করতে হবে সেটা খুব সহজে মনে এসে গেল। পিছনের চালাঘরে এসে দু-চাকার ঠেলাটা টেনে এনে দাওয়ায় লাগিয়ে দিল। ঘরে এসে পরনের জবজবে ভেজা জামা-কাপড় খুলে ফেলে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হল। খুব সহজে ঠেলে ঠেলে নিথর রক্তাক্ত দেহটা ঠেলার ওপর ফেলল। অনায়াসে দেহসুদ্ধ ঠেলাটা টেনে এনে পুকুর ধারে এলো। তারপর ঠেলার পিছন দিকটা উঁচিয়ে তুলতে দেহটা আপনি পুকুরে পড়ল। রাধা ঠেলা নিয়ে আবার উঠোনে ফিরল। ঠেলা রক্তে মাখা মাখি, কিন্তু এই মুষল বৃষ্টিতে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ধুয়ে যাবে, আর চাকার দাগের চিহ্নও থাকবে না। হারিকেন হাতে দাওয়াটা খুব ভালো করে দেখল। জায়গায় জায়গায় রক্ত থুবড়ে আছে। এক বালতি জল আর শলা কাটা নিয়ে এলো। মাটির দাওয়া দু’ মিনিটের মধ্যে পরিষ্কার, আর উঠোনে তো বৃষ্টির জলের স্রোত। তবু ঘর থেকে মনোহরের টর্চ এনে আর এক দফা ভালো করে দেখে নিল। রক্তের চিহ্নমাত্র নেই, ঠেলাটাও পরিষ্কার। টর্চ রেখে ঠেলাটা আবার চালার নিচে রাখল। জলে ভেজা, চাকায়ও কাদা মাটি লেগে আছে। একটা ছালা এনে আগে ওপরটা পরে চাকা দুটো ভালো করে ঘসে ঘসে মুছল। হারিকেনের আলোয় দেখল। এতেই হবে।
ঘরে এসে ওই ভেজা জামা-কাপড় পরে নিয়ে হারিকেনের আলো কমিয়ে ঘরের কোণে রেখে রাধা আবার জংলা পথে মায়ের কাছে ফিরে চলল। সব মিলিয়ে এক ঘণ্টারও সময় লাগেনি বোধহয়।
কপালী বাবা তেমনি ঘুমোচ্ছেন। অন্য কোণে বিলাসী। এবার জবজবে ভেজা কাপড়েই ঘরে ঢুকতে হল। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে মনে হল মা হাসছেন। শুকনো জামা-কাপড় পরে ভেজাগুলো নিঙরে আবার দাওয়ার দড়িতে যেমন ছিল তেমন মেলে দিল। যাতা দিয়ে ঘরটা মুছে শুয়ে পড়ামাত্র আর জ্ঞান নেই।
অংশুমান পাথরের মতো মুখ করে ঘরে পায়চারি করছেন। সুচারু দেবী নিস্পন্দের মতো বসে। রাধা আকুল হয়ে বলল, আর কিছু ভেবনি বড়বাবু, তুমি আমার শাস্তির ব্যবস্থা করে দিয়ে দয়া করে আমাকে এ যন্তন্ন থেকে বাঁচাও–আমাকে মুক্ত করো।
অংশুমান সামনে এসে দাঁড়ালেন।এ ব্যাপারটা তুই আর কাউকে বলেছিস–কপালী বাবাকে বলেছিস?
-বাবাকেই শুধু বলেছি, কিন্তু সে-তো আর কবুল করা হল না, হলে আমার এই দুর্দশা হবে কেন! বাবা তো মেয়ের সব দোষ চাপা দিয়ে মেয়েকে আগলাবেই।
–তুই আমার কাছে এসেছিস তিনি জানেন?
জানলে মুখ হাত-পা বেন্ধে আমাকে ফেলি রাখত, এমনিতেই তরাসে আছে।
তোর ভিতর যে এত যন্তন্না দিচ্ছে সে তোকে শাস্তি নিতে বলছে না, কবুল করতে বলছে?
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো একটু।–একই কথা হল…কবুল করতেই বলছে।
-বেশ। কবুল করা হয়ে গেছে। এরপর সব ভাবনা আমার। কিন্তু এ কথা যদি আর তুই কোনো লোককে বলেছিস তাহলে আমিই তোর সব থেকে বড় শত্রু হব মনে রাখিস। তোর কি হবে জানি না। কিন্তু তোর সঙ্গে কপালী বাবাকেও আমি আসামী সাজিয়ে ফাঁসীতে ঝোলাবই!
রাখা চাপা আর্তনাদ করে উঠল। এ কি বলছ বড়বাবু, বাবা তো ফুলের মতো নিষ্পাপ।
-ওসব আমি জানি না, তুইও ফুলের মতো নিষ্পাপ। যা হয়েছে তা আর ভবিষ্যতে কেউ কোনদিন জানবে না। তোর কবুল করার কথা, কবুল করা হয়েছে, এখন দ্যাখ তোর পুজো আর গান হয় কিনা।
একজন সাব-ইন্সপেক্টরকে দিয়ে জিপে করে ওকে কপালী বাবার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
কিন্তু অংশুমান বা তাঁর স্ত্রী কেউই নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন নি। পরের সন্ধ্যায় জিপে দুজনেই কপালী বাবার ডেরার দিকে রওনা হয়েছেন। পৌঁছুতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। একটু দূর থেকে রাধার খুব পরিচিত গলার গান কানে এলো। নিঃশব্দে তারা দাওয়ায় উঠে দাঁড়ালেন। কপালী বাবা হাত তালি দিয়ে দিয়ে তাল রাখছেন, রাধা ঠিক আগের মতোই দু’চোখ বুজে ভাবে বিভোর হয়ে দুলে দুলে গাইছে।
‘কালী-নামের গণ্ডী দিয়ে আছি দাঁড়াইয়ে।
শোন্ রে শমন তোরে কই
আমি তো আটাশে নই,
তোর কথা কেন রব সয়ে।
এতো ছেলের হাতের মোয়া নয় যে,
খাবি হুমকি দিয়ে।
বলৰি সাজা পাবি
মা-কে দিব কয়ে,
সে-যে কৃতান্তদলী শ্যামা বড় ক্ষ্যাপা মেয়ে।
সুচারু দেবীর দুই গাল বেয়ে ধারা নেমেছে। অংশুমানের চোখও শুকনো নয়।