আমি হেসেই বললাম, খুব আনন্দের কথা, কিন্তু আপনার মেয়ের বেশি শত্রু হয়ে উঠতে আমি রাজি নই–
চা খেতে খেতে মাথা নাড়লেন, যা বলেছেন, যত বয়েস হচ্ছে মেয়েটার চোখে আমি ততো যেন খোকা হয়ে যাচ্ছি। আমার পেয়ালা অর্ধেক খালি হবার আগেই তাঁর পেয়ালা শেষ। রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, যাক, এতক্ষণ তো কেবল নিজের কথাই হল, এবারে আপনার কথা শোনান, নইলে মেয়ে আর বউমাকে কি বলব?
কিছুই বলতে হবে না, কেবল তারা এলে একদিন এখানে পাঠিয়ে দেবেন, বলবেন খুব খুশি হব।
–বাঃ, আমার দায়িত্ব শেষ।–তা আপনি হার্ট পেশেন্ট বলতে কি–বয়েস তো তেমন বেশি মনে হয় না?
–বছর পাঁচেক আগে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে, তারপর থেকে একটু আধটু ধকল পোহাতে হচ্ছে। জবাব সেরে বললাম, আপনি সবে রিটায়ার করলেন, আপনার চোখেও বয়েস বেশি মনে হয় না?
হাসতে লাগলেন।–এই তো আবার জোচ্চুরি কবুল করিয়ে ছাড়লেন, তবে অপরাধটা আমার নয়, আমার পিতৃদেবের, য়ুনিভার্সিটির সার্টিফিকেটে বয়েস তিন বছর কমানো ছিল, অন্য দিকে কর্তারা এক বছর এক্সটেনশনে রেখেছিলেন, তাহলে আসল বয়েস আমার বাষট্টি পেরিয়ে গেল।
বললাম, তবু আমার থেকে পাঁচ বছর পিছিয়ে আছেন।
-বলেন কি! দেখে তো মনে হয় না, কি আর করা যাবে, সিনিয়রিটি মেনে নিলাম। এবারে লেখার কথা শুনি, আপনার অনেক গল্প নাকি সিনেমা হয়েছে নাটক হয়েছে, তার মানে আপনি কেবল উপন্যাস আর গল্প লেখেন?
-অনেকটা তাই বলতে পারেন।
বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন।-আমার গল্প উপন্যাস পড়ার দৌড় শরৎবাবু পর্যন্ত। একবার বঙ্কিম ধরেছিলাম, বড় বড় শব্দ আর তার অলংকার ডিঙোতে পারলাম না–রবীন্দ্রনাথও চেষ্টা করেছিলাম, চোখ ঢোকে তো মন ঢোকে না, লজ্জার কথা আর বলবেন না।
বলার মধ্যে এতটুকু দম্ভ নেই বলেই ভালো লাগছে।
–এবারে আমার আর একটু আরজি আছে।
আমার সপ্রশ্ন দৃষ্টির জবাবে বলেন, বাড়ির কারো যদি অসুবিধে না হয় আপনাদের পুজোর ঘরখানা একবার দেখব।
চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালাম, অসুবিধের কি আছে, আসুন–
তিনিও উঠলেন। রোজ রাতে কাঁসর ঘন্টা শঙ্খ বাজে, ভারি ভালো লাগে–আপনাদের গৃহ দেবতা হলেন…?
–নৃ-সিংহ নারায়ণ, তিনশ’ বছরের বিগ্রহ, দেশের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, শুনেছি এককালে স্বপ্নাদিষ্ট মানুষ অনেক দূর থেকে পুজো দিতে আসত–পার্টিশনের গুঁতোয় দেবতাটিকেও ভিটে ছাড়া হতে হয়েছে। ঠাকুরঘরের দিকে যেতে যেতে হেসে জানান দিলাম, আমাদের দারুণ কিছু ভক্তি-নিষ্ঠা আছে ভাববেন না যেন–বাবা মায়ের আমলে যা চলত এখনো সেটা চলে আসছে।
ছোট্ট মন্তব্য, তাই বা কম কি।
পুজোর ঘরের দু-হাত দূরে পায়ের শৌখিন চপ্পল খুললেন। সামনেই কল দেখে হাত ধুলেন, পায়ে জল দিলেন। তারপর দু-হাত যুক্ত করে পুজোর ঘরে ঢুকলেন। ভেবেছিলাম নারায়ণের সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত দেখব, জোড় হাতে দাঁড়িয়ে খানিক দেখলেন, মনে হল প্রণামটুকু চোখেই সেরে নিলেন। তারপর এদিকে বড় কালীর পটের দিকে চোখ গেল। কাছে এগিয়ে এলেন, নিরীক্ষণ করে দেখলেন, মনে হল নারায়ণের থেকেও কালীর প্রতিই তাঁর আগ্রহ বেশি। এখানেও যুক্ত হাত আর চোখে প্রণাম। ভারি গলার স্বর খুব মৃদু, বললেন, যেমন সুন্দর তেমনি স্নিগ্ধ, এমনটি সচরাচর চোখে পড়ে না, কোথায় পেলেন?
–ঠিক বলতে পারব না, মায়ের কালী, পঁয়ষট্টি বছর মা পুজো করে গেছেন, সেই পুজোই চলছে।
ফিরলেন। মুখখানা ভাব-গম্ভীর। চোখে দূরের তন্ময়তা। এই ভাবান্তরের সঙ্গে চাকরিগত কোনো পাপবোধ জমা দেওয়ার যোগ আছে আজ অন্তত তা মনে হল না।
আলাপ এরপর মন-খোলা হৃদ্যতার দিকে এগিয়েছে। মানুষটা বাইরে যত রাশভারী গম্ভীর, ভিতরে আদৌ তা নন। তাঁর চাকরির আমলের দাপটের খবর রাখি না, কিন্তু এখনকার গাম্ভীর্যটুকু নিজেকে আড়াল করার আবরণের মতো মনে হয়।
তিন চার দিনের মধ্যেই এক সন্ধ্যায় তার মেয়ে-জামাই ছেলে ছেলের বউ এসে হাজির। মেয়ে বলল, আসার পাসপোর্ট পেয়ে সকলেই এসে গেলাম।
শিক্ষার সহজাত বিনয়ের মাধুর্য দেখলাম আবার বেশ সপ্রতিভ হাসি খুশিও। ছেলে দুটোর বড় চাকরির দেমাক নেই, মেয়ে দুটিও নিরহঙ্কার। ছেলে-ছেলের বউয়ের নাম অমিতাভ আর ঊর্মিলা, মেয়ে জামাইয়ের নাম শমী আর দেবব্রত। মেয়ের দুটি ছেলে, বয়েস এগার আর আট। ছেলের একটি মেয়ে, বয়েস সাত। আমি এদের চারজনকে অনেকবারই আসতে যেতে দেখেছি, এদের ছেলেমেয়েদের দেখিনি। শুনলাম, নাতি-নাতনীরা প্রত্যেক রবিবার সকালে দাদুর কাছে আসে আর বিকেলে ফেরে। সেই দিন আবার সকালে আমার ঘরে জোর আড্ডা বসে, আর দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত কনট্রাক্ট ব্রিজ চলে। তাই চোখে পড়েনি।
মেয়ে শমী আর বউ ঊর্মিলার যেটুকু উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করলাম তা কেবল সাহিত্য নিয়ে। এই কোণের ঘরে বসে লিখি শুনে আগ্রহ সহকারে চারদিক দেখে নিল। উঠে কাচের আলমারির বইগুলোও দেখল। তারপর প্রশ্ন, কখন লিখি, কতক্ষণ লিখি, কিভাবে প্লট সংগ্রহ করি ইত্যাদি। ঊর্মিলা বলেই ফেলল, সামনা সামনি একজন সাহিত্যিককে আমি এই প্রথম দেখলাম।
আমি যোগ করলাম, এবং খুব হতাশ হলে।
হাসি ছাড়া এর আর কি জবাব। ছেলে আর জামাইয়ের দিকে ফিরে বললাম, বড় কোম্পানির বড় এনজিনিয়ার–তোমরাও কি সাহিত্য রসিক নাকি?