এরপর সেই দিনই অংশুমান কলকাতায় ছুটেছেন। কলকাতার শ্ৰনাথ পোদ্দারের সেই বন্ধুর বাড়িতে হানা দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, শ্রীনাথ তার গাড়িটা সেই দিনের মতো ধার নিয়ে গতকাল বিকেলের মধ্যেই চলে গেছে। না ড্রাইভার নেয়নি, তার সঙ্গী সূর্যকান্ত এক্স পার্ট ড্রাইভার। কথা ছিল সূর্যকান্ত আজ বিকেলের মধ্যেই গাড়িটা ফেরত দিয়ে যাবে। এতক্ষণে গাড়িটা ফিরে আসা উচিত ছিল।…ঘটনা শুনে ভদ্রলোক হতবাক।
এবারে অংশুমানের হিসেবের অনেকটাই মিলছে। …এটাই ঐনাথের বড় চাল ছিল। অহের গাড়িতে সূর্যকান্তকে নিয়ে সে সন্ধ্যার অন্ধকারে বারুইপুরের বাগানবাড়িতে আসবে। কেউ জানবে না কেউ সন্দেহ করবে না। পরদিন সকালে বা রাতে মনোহর আর তার তিনজন লোক রাধাকে নিয়ে আসবে। সাফ প্ল্যান।…লক্ষ্মী কান্তপুরের ওই চেলাদের মধ্যেই তারা তিনজন ছিল, রাধাকে না পেয়ে তারা মনোহরকে ওভাবে খুন করে গেছে। তারা কারা, অংশুমানের তা নিয়ে আর খুব মাথা ব্যথা নেই। কারণ ওই একটা, একটা কেন শ্ৰীনাথ পোদ্দারের মৃত্যুর জন্যও তার মনে কোনো আক্ষেপ নেই। তিনি কেবল আনুষ্ঠানিক কর্তব্য করে গেছেন। শ্রীনাথ পোদ্দারের বন্ধুর গাড়ির হদিস আজও মেলেনি।
কেস মোটামুটি ধামাচাপা। অংশুমান তার বদলি আর প্রমো শনের জন্য আবার জোর তদবি শুরু করেছেন। আট-আটটা বছর হতে চলল, একই জায়গায় একই পোস্টে পড়ে আছেন।
বড় কর্তাদের কাছে আশ্বাস পেয়েছেন, শিগগীরই তাঁর সম্পর্কে সুবিবেচনা করা হবে।
*
মাস দুই পরে এক সন্ধ্যায় রাধার মূর্তি দেখে অংশুমান তাঁর স্ত্রী সুচারু দেবী হতভম্ব। মাতন থেকে থানা পর্যন্ত আড়াই মাইল পথ হেঁটে এসেছে। সাদা-মাটা বেশবাস পরিচ্ছন্ন নয়, আধ ময়লা শাড়ি, আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছে, মাথায় তেল চিরুনি না পড়ে এক পিঠ চুলে জট বেঁধে গেছে। এযেন সেই ঢলঢলে মিষ্টি মুখ কালো মেয়েটাই নয়। অনেক অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করার পরেও রাধার এমন মূর্তি দেখেননি অংশুমান। চোখে মুখে অব্যক্ত যন্ত্রণার ছাপ, ঠোঁট দুটো কাঁপছে, চোখ দুটো অস্বাভাবিক ঝকঝক করছে।
সুচারু দেবী তাড়াতাড়ি তাকে ঘরে এনে বসালেন।–কি হয়েছে? এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে?
রাধার উদ্ভ্রান্ত চাউনি অংশুমানের মুখের ওপর। ঠোঁট দুটো আরো বেশি কাঁপছে। জবাব দিল, বড়বাবু দয়া না করলে আরো খারাপ দেখবে, রাধার শেষ দেখবে।
অংশুমান কাছে এগিয়ে এলেন, এসব কি বলছিস তুই, কি হয়েছে?
বসা থেকে উঠে রাধা মাটিতে আছাড় খেয়ে তার দু-পা আঁকড়ে ধরল, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে বড়বাবু, এক তুমি ছাড়া আর কেউ আমাকে রক্ষা করতে পারবে না।
পা ছাড়িয়ে দু’হাতে ওকে টেনে তুললেন। সুচারু দেৰী আবার ওকে ধরে জোর করে বসালেন। অংশুমানও অধীর, কি হয়েছে বলবি তো?
-মা আমার গান কেড়ে নেছে, তাকে ডাকতে পারি না, পুজো করতি পারি না, তার নাম শোনাতে পারি না। এমন হলে বাঁচব কি করে বড়বাবু।
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বিমূঢ়। অংশুমান জিগ্যেস করলেন, গান করতে পুজো করতে নাম করতে পারিস না কেন?
-গলায় কে কুলুপ আঁটে, আর ভেতর থেকে কে ধমকায়, কবুল করলি না কেন, কবুল করলি না কেন–এত ভয় বুকে নিয়ে, সত্যের মুখ চাপা দিয়ে গান হয় পুজো হয় না হয়। যা দুর হ–দূর হ!
অংশুমানই দিশেহারা।-কি কবুল করিসনি। কোন সত্যের মুখ চাপা দিলি?
চাউনি বদলাতে লাগল, টান টান হয়ে বসল। ঝকঝকে চোখ দুটো বড়বাবুর মুখের ওপর এটে বসতে লাগল। গলার স্বরও বদলে গেল।ওই ঝড়জলের রাতে মনোহর পাইককে আমি খুন করেছি, আমিই তাকে কুড়ুল দিয়ে কুপিয়ে মেরেছি।
সুচারু দেবীর গলা দিয়ে একটা শব্দ বেরিয়ে আসছিল, হাতে করে নিজের মুখ চাপা দিলেন। অংশুমান একটা ঝাঁকুনি খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সামনের দরজা দুটো বন্ধ করে দিলেন। কাছে এসে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইলেন খানিক।–তোর সঙ্গে আর কে ছিল–কপালী বাবা?
-না না না! আমি একা করেছি, কেউ আমার সঙ্গে ছেল না!
-এতবড় শরীরটাকে একলা তুই টেনে এনে পুকুরে ফেললি কি করে।
কিছু কঠিন হয়নি, সব ব্যবস্থা সাজানো ছেল, আগে শোনো, আর তো তোমার কাছে মিছা বলব না, সব কবুল করে আমি সাজা নেতে এয়েছি, ফাঁসী যেতে হলেও কটা দিন বুক ভরে মায়ের পুজো মায়ের গান করতি পাব–যাবজ্জেবন জেল হলে তা পাবই।
এরপর অভিভূত হয়ে ঘটনা শুনলেন দুজনে।
…না রাখা অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে শ্রীকান্ত পোদ্দারের কাছে যাবে বলেনি। মেরে ফেললেও বলার কথা নয়। কিন্তু কেউ তাকে দিয়ে আচমকা বলিয়েছে যাবে। রাধা নিজেকে ভস্ম করতে চেয়েছে আর যে বলিয়েছে তাকেও।…মনোহর তখন বেহুঁশ ঘুমে। ঝড় জল মাথায় করে রাখা পিছনের জংলা পথে কপালী বাবার ডেরায় জংলি কালীর কাছে এসেছে। ভেজা জামা-কাপড় বদলে মায়ের কাছে বসেছে। আর অসহ্য যন্ত্রণায় পাগলের মতো জানতে চেয়েছে মা কেন ওর মুখ দিয়ে যাবে বলালো।
হঠাং ঝিমুনি এসে গেছল। শুয়ে পড়েছিল। কতক্ষণ জানে না, রাত কত জানে না। ঝাঁকুনি খেয়ে উঠে বসেছে।…তাকে যেতে হবে। নিয়ে যেতে ভোর-ভোর লোক আসবে। ও বলেছে যাব। তখনো প্রবল বৃষ্টি। কপালী বাবা দাওয়ায় ঘুমোচ্ছন। তাঁর মাথার কাছে ছোট মদের বোতল আর গেলাস। তিনি গাঢ় ঘুমে। দড়ি থেকে ভেজা জামা-কাপড় নিয়ে রাধা ঘরে এসে পরে নিল। শুকনো জামা-কাপড় যেখানে থাকে রেখে দিল। মা-কে শেষবারের মতো দেখে নিয়ে নেমে এলো।