রাধার ওখানে দুজন কনস্টেবলকে প্রহরায় রেখে অংশুমান থানায় ফিরলেন। বারুইপুর থানার ও. সির সঙ্গে ফোনে কথা বলে নিলেন। তারপর প্রথমে মনোহরের বডি আনার ব্যবস্থা করে নিজে কিছু লোক নিয়ে ভ্যানে বারুইপুর ছুটলেন। আর ক’জনকে নির্দেশ দিয়ে সমীকান্তপুরে পাঠালেন।
ভ্যানে বারুইপুর খুব দুরের পথ নয়। লোকজনকে জিগ্যেস করে শ্রীনাথ পোন্দারের বাগানবাড়ির হদিস পেতে সময় লাগল না। বারুইপুর থানার ওসি সদলে আগেই পৌঁছে গেছে। উঁচু পাঁচিল ঘেরা অনেক জমি আর গাছপালার মাঝে বাগানবাড়ি। খুব কাছা কাছির মধ্যে আর কোনো ঘরবাড়ি নেই।
সামনের মস্ত গেট দুটো হাঁ-করা খোলা। অংশুমান দল-বল সমেত ভ্যান নিয়ে ঢুকলেন। নেমে ডাকাডাকি করতেও বাড়ি থেকে কেউ সাড়া দিল না। মস্ত একতলা দালান, সারি সারি অনেক ঘর। একটা ঘরের কেবল সামনের দরজা খোলা। সদলে ঢুকলেন। আবার হাঁকডাক করলেন। কিন্তু বাড়িতে জনপ্রাণী আছে বলে মনে হল না। এর ওঘর করে যে-ঘরে এলেন, দেখেই বোঝা গেল মালিকের বিলাস কক্ষ। মস্ত জোড়া খাট পাতা, কাঁচের আলমারিতে সারি সারি বিলিতি মদের বোতল। টেবিলের ওপরেও আধ-খাওয়া মদের বোতল, মদের গেলাস, খাবারের প্যাকেট। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ঘরের চারদিক আগে দেখে নিহিলেন অRমান, জোড়া পালনের দিকে চোখ পড়তে রঙিন বেডকভারটা কেমন এলোমেলো মনে হল, বাচ্চা ছেলেরা ধস্তাধস্তি করলে যেমন হয়।
এগিয়ে এলেন। তারপরেই চক্ষু স্থির। রঙিন বেড কভারে চাপচাপ রক্ত। ভালো করে নজর করে দেখেন গোলাপী কার্পেটেরও জায়গায় জায়গায় রক্তে ভেজা। ,
অংশুমান পকেট থেকে রিভলভার বার করলেন, সঙ্গের দুজনও। কনস্টেবলদেরও অস্ত্র তাদের হাতে। একসঙ্গে এঘর ওঘর খোঁজ হতে লাগল। কোনো ঘরে কেউ নেই। পিছনের দিকের একটা ছোট মতো ঘরের শেকল তোলা। শিকল নামিয়ে দরজা খুলতেই মনে হল চাকর বাকরের ঘর হবে। পরের মুহূর্তে আবার চক্ষু কপালে সকলের।
খাটিয়ার ওধারে মেঝের ওপর একটা নয়, দু-দুটো গুলিবিদ্ধ দেহ।
তাদের একজন নিঃসন্দেহে শ্রীনাথ পোদ্দার। তার কপালে আর গলায় গুলি করা হয়েছে।
দ্বিতীয় জোয়ান গোছের লোকটা অচেনা। সে যুঝেছিল কিনা বলা যায় না, তার দেহে অনেকগুলো গুলির চিহ্ন।
–শ্রীনাথ পোদ্দারের রক্তে ভেজা জামার পকেটে একটা কাগজ উঁচিয়ে আছে। অংশুমান সন্তর্পণে সেটা টেনে নিয়ে ভাঁজ খুললেন।
অস্ত্রের বিশেষ রকমের ছাপ দেওয়া এক বিশেষ রকমের নক্সা কাটা কাগজ। এই ছাপ এই নক্সা খুব ভালোই চেনেন অংশুমান। নকশালদের এক বিশেষ গোষ্ঠীর খতমের চিহ্ন এটা। এই কাগজ পাঠিয়ে তারা হুমকি দেয়, আবার খতমের পর এই চিহ্ন রেখে গিয়ে তারা তাদের জয় ঘোষণা করে।
বাগান বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আর কিছুই চোখে পড়ল না। কোনো গাড়ি বা চাকার দাগের চিহ্নমাত্র নেই।
চারজন সশস্ত্র লোককে প্রহরায় রেখে অংশুমান অন্যদের নিয়ে সেখান থেকেই লক্ষ্মীকান্তপুরের দিকে ছুটলেন।
ভেবে চলেছেন। চেষ্টা করেও ঘটনা মেলাতে পারছেন না।…গাড়ি বা চাকার দাগ নেই যখন প্রবল ঝড়-জলের মধ্যেই ব্যাপারটা ঘটেছে। অবশ্য চাকার দাগ আছে কিনা জল শুকোলে বোবা যেতে পারে, গেট থেকে বাড়ির সিঁড়ি পর্যন্ত এখনো জলে জলাকার।… মত ঝড় জলে অনেক কাছ থেকেও কারো গুলির শব্দ শুনতে পাবার কথা নয়। কিন্তু বাকি তিনটে লোক যাদের ভোর-ভোর রাধাকে নিতে আসার কথা ছিল, তারা গেল কোথায়? হতে পারে তাদের লক্ষ্মীকান্তপুর থেকেই আসার কথা ছিল। তাহলে ধরে নিতে হয় শ্রীনাথ পোন্দার কেবল একজনকে নিয়েই রাতে ওই বাগানবাড়িতে ছিল। কিন্তু অত চতুর আর সাবধানী লোকটার এত সাহস হবার কথা নয়।…অথচ বড়সড় মাত্র দুটোই খাবার প্যাকেট ছিল, আরো তিনজনের পক্ষে যথেষ্ট নয়। টেবিলে মদের গেলাসও দুটোই ছিল।
শ্রীনাথ পোদ্দারের খুব বিশ্বস্ত চেলার সংখ্যা ষাট জনের ওপর। অংশুমান আগে যাদের পাঠিয়েছিলেন তারা জেরা করেও হদিস পায়নি কোন্ তিনজনের ভোর রাতে মনোহর পাইকের কাছে আসার কথা ছিল। এখান থেকে বেরুবার সময় সঙ্গে কারা ছিল সেই জেরা করতে গিয়ে তারা শুনেছে, শ্রীনাথ পোন্দার এখন কলকাতায়, যাবার সময় তার অন্তরঙ্গ বন্ধু তার সর্বদার সঙ্গী সূর্যকান্ত হালদার ছিল, তিনজন বডিগার্ড ছিল আর মনোহর পাইক ছিল। সকাল দশটা নাগাত তিনি নিজের বড় গাড়িতে সকলকে নিয়ে কলকাতা রওনা হয়েছেন। হ্যাঁ, তাঁর ড্রাইভার মুকুন্দই গাড়ি চালাচ্ছিল। শ্ৰনাথ পোদ্দারের ওমুক বন্ধুর বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে কেবল সূর্যকান্ত ছাড়া আর সকলে বিকেলের মধ্যে লক্ষ্মীকান্তপুরে ফিরে এসেছে। কলকাতাতেই তাঁর তিন চার দিন থাকার কথা। হ্যাঁ, ওই গাড়িতে তাদের সঙ্গেই মনোহর পাইকও ছিল, সে জয়নগরে নেমে গেছল, তার সঙ্গে শ্রীনাথ পোদারের কি কথা হয়েছে তারা জানে না।
অংশুমানের আরো জোরালো জেরার ফলও একই। আধ-বুড়ো মুকুন্দ ড্রাইভার বার বার দিব্য কেটে বলল, এই-এই কজন আর মনোহর পাইককে নিয়ে সে বিকেলের মধ্যে ফিরে এসেছে। তার জেরায় জানা গেল, সূর্যকান্ত হালদার সুপটু ড্রাইভার, অনেক সময়েই শ্রীনাথ পোদ্দার ড্রাইভারকে না নিয়ে তাকে নিতেন।
বলা বাহুল্য বাগানবাড়িতে নিহত দ্বিতীয় মানুষটার সঙ্গে সূর্যকান্ত হালদারের চেহারার বর্ণনা নিঃসংশয়ে মিলছে।