এসব কথা সে তোমাকে বলতে গেল কেন?
নিতাই সেকরা থতমত খেল একটু।– আজ্ঞে হুজুর ও জিনিস পেটে পড়লেই ও গলগল করে কথা বলত–আর একটু চেষ্টা করলেই ওর ভেতর থেকে সব কথা টানি বার করা যেত।
–তাহলে তুমি বলতে চাও, ভোর রাতে যাদের আসার কথা ছিল রাধাকে ঘরে না পেয়ে তারাই মনোহরকে খুন করে পুকুর ধারে ফেলে রেখে গেছে।
নিতাই আবার দু’হাত জোড় করে ফেলল, আমি কিছু বলতে চাই না হুজুর–কিছুটি না।
সেখান থেকে ভ্যানে কপালী বাবার ডেরায় চললেন। কপালী বাবাকেও তুলে নেওয়া হয়েছে। অংশুমান তাঁকে কেবল জিগ্যেস করলেন, রাধা তাহলে এখন পর্যন্ত কিছু জানে না?
বিলাসীকে ওর কাছে রেখে এসেছি, সে শুনেছে–এতক্ষণে বলেছে কিনা জানি না।
অংশুমান ভাবছেন, কোনো একজনের পক্ষে এতবড় মানুষটাকে খুন করে পুকুর ধারে টেনে এনে ফেলা সম্ভব নয়। একাধিক লোকই ছিল। অত ঝড় জলের দরুন জুগে বা পায়ের ছাপ ধুয়ে গেছে।
একজন সাব-ইন্সপেক্টরকে কুড়ুলটা আনতে বলে সঙ্গে ডাক্তার চৌধুরীকে নিয়ে অংশুমান কপালী বাবার ডেরায় এলেন। বাবাও সঙ্গে। রাধা তখনো জ্বর-ঘুমে আচ্ছন্ন। বিলাসী তখনো জলপটি লাগিয়ে হাত-পাখা দিয়ে মাথায় বাস করছে। লোকজনের সঙ্গে বাবাকে দেখে ও পাখা হাতে নিয়েই ছুটে এলো।মেয়েটাকে মেরে মেরে আধমরা করেছে গো বাবা, দুই হাতে আর ঘাড়ে কোমরে মারের দাগ দেখে সন্দ হতে আমি বেলাউস টানি তুলি পিঠ দেখলাম, দেখে যাও কি অবস্তা।
পায়ের জুতো খুলে সকলে ঘরে ঢুকলেন। রাধা ওপাশ ফিরে অচেতনের মতো শোয়। বিলাসী প্রথম একদিকের বাহুর আর ঘাড়ের দাগ দেখালো। তারপর সন্তর্পণে ঢিলে ব্লাউসটা অনেকটাই টেনে তুলে পিঠ দেখালো। বিজন ডাক্তার আঁতকে উঠলেন, সর্বনাশ এতে টিটেনাস হয়ে যেতে পারে।
কপালী বাবা রাগের চোটে হুংকার দিয়ে উঠলেন, মনোহরের এ দশা যে করেছে আমি তাকে আশীর্বাদ করছি–আশীর্বাদ করছি।
অংশুমান চাপা ধমক লাগালেন, থামুন।
অস্ফুট একটু যন্ত্রণার শব্দ করে না আস্তে আস্তে চিত হয়ে শুলো। কিছু অনুভব করল কিনা সে-ই জানে। চোখ মেলে তাকালো। রক্তবর্ণ চোখ, কিন্তু ঘরের মোক দেখে ফ্যালফেলে চাউনি। নিজের গোয় বুকের কাপড় টেনে নিল। আস্তে আস্তে উঠে বসে শাড়ির আঁচলটা পিঠ বেড়িয়ে জড়িয়ে নিল।
বিজন ডাক্তার এগিয়ে এসে কপালে হাত দিয়েই ভুরু কোচ কালেন। ব্যাগ খুলে থার্মোমিটার লাগিয়ে মুখে দিলেন। রাখা সকলকে দেখছে, তখনো আত্মস্থ নয়। থার্মোমিটার মুখেই মুখ উঁচিয়ে একবার জংলি কালীকে দেখে নিল। ও কোথায় এতক্ষণে স্পষ্ট হল যেন।
জ্বর মুখে একশ পাঁচের কাছে। ডাক্তার পরীক্ষা শেষ করে ব্যাগ খুলে তখনকার মতো দুটো বড়ি শুধু খাওয়াতে পারলেন। একটা প্রেসকৃপশন লিখে বাবার হাতে দিয়ে বললেন, এ ওষুধগুলো আনিয়ে এই-এইভাবে খাওয়াতে থাকুন, আমি বিকেলে এসে আবার দেখে যাব এখন নাড়াচড়া চলবে না।
রাধা স্থির চোখে সকলকে দেখছে। বলল, অমন জ্বর প্রায় রোজই হতেছে, ভেনিতোমরা এখেনে কেন? লাল দুচোখ বড়বাবুর মুখের ওপর ঘুরল।
রাধার শরীরের অবস্থা দেখতেই পাচ্ছেন অংশুমান, তবু সুযোগ পেলে পুলিশের কর্তব্য আগে। জিগ্যেস করলেন, তুই অত রাতে ঝড় জল মাথায় করে এখেনে এসেছিলি কেন?
চোখে চোখ রেখে রাধা জবাব দিল, মা-কে শেষ দেখা দেখি যেতে এয়েছিলাম।
শেষ দেখা কেন?
তেমনি চেয়ে থেকে রাখা থেমে থেমে জবাব দিল, খুব ভোর ভোর ছিনাথ পোদ্দারের তিনজন লোক আসি আমাকে তার বারুইপুর বাগানবাড়িতে নে যাবার কথা ছেল, সেখেন থেকে ফিরে আর মায়ের মুখ দেখা হত না
বক্তব্য বুঝলেন অংশুমান।–তিনজন লোক আসার কথা ছিল কেন, মনোহরই তো নিয়ে যেতে পারত।
এবারে না গেলে তারা আমাকে রাতের অন্ধকারে মুখ বাঁধি নে যেত।
–তার মানে মনোহর আগেও তোকে অনেকবার নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে?
দেড় মাস ধরে
এবারে তুই যেতে রাজি হয়েছিলি?
–হাঁ, যাব বলেছিলাম।
–অমন ঝড় জলে তোকে বেরুতে দেখে মনোহর কিছু বলেনি?
-সে তখন এক বোতল মদ খেয়ে দাওয়ায় বেহুশ হয়ে পড়েছিল, ধাক্কা মেরে বিষ্টির মধ্যে উঠোনে ফেলে দিলেও ঘুম ভাঙত না।
অংশুমান ঘুরে সাব-ইন্সপেক্টরকে ইশারা করতে সে কুড়ুল হাতে সামনে এগিয়ে এলো। ওটা নিয়ে অংশুমান সামনে ধরলেন।এটা তোদের কুড়ুল?
রাধা দেখল। আস্তে আস্তে তার মেরুদণ্ড সোজা হল। তারপর কেবল মাথা নাড়ল। তাদেরই।
-এটা কোথায় থাকে?
–চেলা-কাঠের ঢিপির ওপর।
দোতারাবাবুর মুখে যে-কারণে যে অত্যাচারের কথা শুনেছিলেন অংশুমান, তা মিলছে। আর নিতাই সেকরার আজকের কথাও মিলছে, শ্ৰনাথ পোদ্দারের তিনজন লোক এসে রাধাকে নিতে আসার কথা ছিল, মনোহর একা নিজের ওপর ভরসা রাখতে পারেনি।
এবারে যা ঘটেছে অংশুমান আস্তে আস্তে রাধাকে বললেন। রাধা শোনার আগেও যেমন পরেও তেমনি। অত জ্বরের জন্য নয়, ওর সবেতে এই অবিচলিত ভাব দেখে অভ্যস্ত। তাঁর মুখের ওপর সোজা চোখ রেখেই শুনল।
অংশুমানের এবার ফেরার তাড়া। সামনে এখন গুরুতর কাজ। আর আসবেন বলে উঠলেন, দুপা এগিয়েও ফিরলেন। কপালী বাবাকে জিগ্যেস করলেন, দাওয়ার দড়িতে ভেজা শাড়ি জাম-টামা দেখছি–রাধার?
কপালী বাবা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে জবাব দিলেন, মায়ের পুজো আজকাল বাধাই করে বলে ওর একপ্রস্থ ধোয়া জামা-কাপড় মায়ের ঘরেই থাকে। কাল রাতে ভিজে চুপসে আসতে এগুলো ছেড়ে ওগুলো। পরেছিল।