.
ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভাঙলো। বিলাসী ঠেলছে। দাওয়ার সামনে দুজন লোক দাঁড়িয়ে, তাদের চোখ খুব স্বাভাবিক নয়। উঠে চোখ মুছতে মুছতে কপালী বাবা ঘড়ি দেখলেন। সকাল সাতটা বাজে। বৃষ্টি পড়ছে না, কিন্তু আকাশ মেঘলা বলেই মনে হচ্ছে খুব সকাল।
লোক দুটো উত্তেজিত মুখে যে-খবর শোনালো, কপালী বাবার সর্ব শরীর নিস্পন্দ, স্থির একেবারে।-সকালে জংলা পথে পাড়ার দুজন লাক হাটমুখে যাচ্ছিল রাধার ঘরের পিছনের পুকুরে একটা লাশ চাখে পড়তে চিৎকার করে লোকজন ডেকেছে। লাশের চারভাগের তিন ভাগ পুকুরে কাদাজলে, বুক থেকে মাথা পর্যন্ত কেবল দেখা যাচ্ছে। ঘাড় কাত করা, তাই দেখেই চিনতে পারেনি, তাছাড়া মুখ জল-কাদায় ভরা। সাহস করে দেহকেউ ছোঁয়নি, কিন্তু লোকজন এসে ভালো করে দেখেই চিনেছে লোকটা কে। মনোহর পাইক। তার ঘাড় দুটো আর কানের নিচে একটা আঘাতের চিহ্ন-ভারি ধারালো কিছু দিয়ে খুন করা হয়েছে। অত বৃষ্টি সত্ত্বেও গায়ের জামার ওপরের দিক রক্তে লাল। …দুজন লোক সাইকেল নিয়ে থানায় খবর দিতে গেছে, আর রাধার ঘরে রাধাকে না পেয়ে এই দুজন এখানে এসেছে। রাখার উঠোনে ছোট একটা কুড়ুল পড়ে ছিল।
খানিক স্তব্ধ হয়ে থেকে কপালী বাবা বুকে ঘরের ভিতরে তাকালেন। রাধা অসাড়ে ঘুমোচ্ছে। কপালী বাবা উঠে ঘরে এলেন। তপতপে মুখের দিকে তাকিয়ে কি-রকম খটকা লাগল। কপালে হাত দিয়েই চমকে উঠলেন, তাঁর হাতে যেন তপ্ত ঘেঁকা লাগল। ঘুমে নয়, জ্বরে বেহুঁশ।
বিলাসীকে কপালে জলপটি দিতে বলে কপালী বাবা লোক দুটোর সঙ্গে রাধার ঘরের দিকে চললেন। অনেকেই সেদিকে ছুটছে। খবর রাষ্ট্র হয়ে গেছে।
রাধার স্বামী মনোহর পাইক খুন হয়েছে আর রাধাও ঘরে নেই শোনামাত্র দুজন সাব-ইন্সপেক্টর আর জনাকয়েক কনস্টেবল নিয়ে অংশুমান ভ্যানে করে বেরিয়ে পড়লেন। বাড়ি থেকে ডাক্তার বিজন চৌধুরীকেও তুলে নিলেন, তিনি মৃত ঘোষণা করলে বডি সন্নানো হবে।
জিপ থেকে নেমে সামনের দরজা দিয়ে ঢুকে সদলে সোজা পিছনের পুকুর ধারে এলেন। সেখানে তখন বহু লোক। তাদের ধমকে সরিয়ে পথ করতে হল। কি অবস্থায় লাশ পড়েছিল আগেই শুনেছেন। অংশুমান দেখলেন একটু। ডাক্তারকে ইশারা করতে তিনি দু মিনিটের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কর্তব্য সারলেন। বডি জলকাদা থেকে টেনে তোলা হল। জলে ধুয়ে ক্ষত তিনটে আর একবার ভালো করে পরীক্ষা করা হল। মনোহরের পরনে ফুলপ্যান্ট, গায়ে টেকিটের জামা। বুক পকেট উঁচু মনে হতে অংশুমান হাত ঢুকিয়ে জলে চুপসানো একতাড়া একশ টাকার নোট বার করলেন। এত ভেজা নোট গোনা সম্ভব নয়, তবু হাজার আড়াই তিন হতে পারে। তাহলে যে বা যারা ওকে খুন করেছে, টাকার লোভে করেনি।
ভিড়ের একদিক থেকে কপালী বাবা এগিয়ে এলেন।–পুলিশ সাহেব ওই নিতাই বলছে কাল সন্ধ্যায় মনোহরের পকেটে সে ওই নোটের পাঁজা দেখেছিল।
অংশুমান তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকালেন।–রাধা কোথায়?
আমার ঘরে।
-আপনার ঘরে কখন থেকে?
রাত তখন সাড়ে দশটা হবে, প্রচণ্ড জলঝড় হচ্ছিল।
–সমস্ত রাত সে আপনার ওখানেই ছিল।
-হ্যাঁ, সকালে এই খবরটা শুনে ওকে তুলতে গিয়ে দেখি জ্বরে বেহুশ।
অংশুমান ডাক্তারের দিকে তাকালেন একবার। তারপর এদিক ফিরে আবার জিগ্যেস করলেন, রাধা এর আগে আর কখনো রাতে আপনার ওখানে থেকেছে?
ইদানিং মাঝে মাঝে থাকত.. ওর ওপর অত্যাচারের মাত্রা খুব বেশি মাত্রায় বেড়ে গেছল মনে হয়।
–ঠিক আছে, নিতাইকে অপেক্ষা করতে বলুন, আপনিও থাকুন।
মনোহরের দেহ কন্স্টেবলরা ধরাধরি করে তুলে এনে ঘরের সামনের দাওয়ায় শুইয়ে দিল। অংশুমান সাব-ইন্সপেক্টর দুজনকে নিয়ে রাধার ঘর রান্নাঘর, পিছনের চালাঘর দেখলেন। রান্না জিনিসের সবই প্রায় পড়ে আছে, চালাঘরে দুচাকা লাগানো একটা ঠেলা শুধু পড়ে আছে। চেলা-কাঠের স্তূপ দাওয়ার ও-পাশে, সেখানে আর কোনো কুড়ুল নেই। কুড়ুল দাওয়ার সামনে উঠোনে পড়ে আছে। দাওয়ার ওপর শূন্য মদের বোতল আর ঘটি।
উঠোনে বা দাওয়ায় কোথাও রক্তের চিহ্ন নেই। উঠোনে টেনে এনে খুন করা হয়ে থাকলে রাতের অত বৃষ্টিতে চিহ্ন থাকার কথাও নয়।
নিতাই সেকরার ডাক পড়ল। উত্তেজনার মাথায় বাবাকে ওই টাকার কথা বলে ফেলে সে এখন জেরার ভয়ে চুপসে আছে। অংশুমানের সামনে এসে জোড় হাতে নমস্কার ঠুকল।
-মনোহরের পকেটে কাল তুমি টাকা দেখেছ না সে তোমাকে দেখিয়েছে?
–টাকা সে বরাবর বুকের পকেটে রাখত হুজুর, ওই পালা জামার ওপর দিয়েই টাকা দেখা যেত–
-ও কিসের টাকা মনে হয় তোমার?
-জানি না হুজুর, ও ছিনাথ পোন্দারের অনেক কম কাজ করত, মোটা মোটা টাকাও পেত।
–সে কাল কখন তোমার ওখানে গেছল?
–সাঁঝের মুখে।
–কতক্ষণ ছিল?
–এক ঘণ্টাটাক হবে।
-কেন গেছল?
ইতস্তত করতে লাগল।
-কেন গেছল? কঠিন গলা।
–আজ্ঞে হুজুর আমাকে দোস্ত ভাবত, গলা ভেজাতে মাঝে মাঝে আসত।
একটি বাজে কথা বলবে না, তোমার সঙ্গে কি কথা হয়েছে সব ঠিক ঠিক বলো।
-আজ্ঞে হুজুর, বলেছেল ছিনাথ পোদ্দারের কাছ থেকে আসছে, রাধা তিন-চার বার তার নেমন্তন্ন বরবাদ করেছে বলে মনোহরের মেজ খুব বিগড়েছেল, বলেছেল, এবার ওর লাশ গেলেও যাবে– ছিনাথদার বাছাই করা তিনজন লোক ভোর রাতে ওদের নেতে আসবে, তখনো যদি রাধা বাদ সাধে তাহলে অন্য ব্যবস্থা হবে।