যাব যাব! যাব!
শেষের দুবার এত জোরে বলল যে হিংস্র মূর্তি মনোহরও থমকালো।
কিন্তু পরের মুহূর্তে রাখা নিজেই দিশেহারা। হ্যাঁ, নিজের কানে নিজের গলা স্পষ্ট শুনেছে! কিন্তু ও তো বলতে চায়নি! মেরে ফেললেও যাবে না এ সঙ্কল্প তো স্থিরই ছিল। তবু বলল কেন? কে বলো? কে? কে? কে? উদভ্রান্তের মতো রাধা ঘরের চারদিকে তাকাতে লাগল।
মনোহরের চোখে মুখে চাপা উল্লাস। মারে মারে সব ধৈর্য আর গো নিঃশেষ ভেবেছে। দাতে দাঁত চেপে বলল, কথার আর নড়চড় যেন না হয়, রাতে আমার সুটকেসে কিছু শাড়ি জামা গোছগাছ করে রাখবি, লোক তিনটে রাত থাকতে আসবে, আমার ঘুম না ভাঙলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে তুলে দিবি। উঠোনের দরজা খোলাই থাক
ঘোরালো ধারালো দু’চোখ একবার মুখের ওপর বুলিয়ে নিয়ে আলনার কাছে চলে গেল। ওটার পিছনে মাটির দেয়াল-তাতে রমজত থাকে, আস্ত বড় একটা মদের বোতল বার করে ওটা খুলে কাঁচাই গলায় ঢালল খানিকটা। বোতল নিয়ে হেঁসেলের দিকে গেল। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে কি খেল সে-ই জানে। বোতল গেলাস আর জলের ঘটি নিয়ে দাওয়ায় বসল। দেড় মাস ধরে তার স্নায়ুব ওপর দিয়েও কম ধকল যায়নি। আজ সব ধুয়ে মুছে যাবে।
রাধার তখনো দিশেহারা মূর্তি। না, সে যাবে কক্ষনো বলতে চায়নি, কক্ষনো না! কিন্তু নিজের কানে নিজের গলা শুনছে। কে-কে বলালো তাকে দিয়ে!
ঘণ্টা দেড়েক হবে হয়তো। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। তেমনি ঝড়ো বাতাস। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, থেকে থেকে বজ্রপাত হচ্ছে।
ঘরে রাধা স্থাণুর মতো বসে। বিড়বিড় করে বলেই চলছে, কে বলালে–কে বলে
দাওয়ায় মনোহর পাইক বেহুশ ঘুমে। এত খেয়েছে যে মুখ দিয়ে গাঁজা বেরুচ্ছে। জল ঝড়ের তাণ্ডবে তার নাসিকা গর্জন শোনা যাচ্ছে না। খালি বোতলটা বাতাসে হোক বা পায়ের ধাক্কায় হোক, দাওয়ায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। ঘটিটাও এক কোণে উপুড় হয়ে আছে।
-কে? কে বলালে? কে বলালে?
আরো আধঘণ্টা বাদে রাধা উঠল। দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। লোকটা মরার মত পড়ে আছে। যত ঝড়-জলই হোক, সমস্ত রাত এভাবেই কাটবে। ঘর থেকে লণ্ঠনটা এনে দরজায় দাঁড়িয়েই মুখের কাছে ধরল। রাধা শিউরে উঠল। বীভৎস। এমন বীভৎস আর কখনো মনে হয়নি। রাধা লণ্ঠনটা আবার জায়গায় রাখল। শাড়িটা গাছকোমর করে শক্ত করে এটে নিল। ঘর থেকে বেরিয়ে দাওয়ার এ মাথায় এসে উঠোনে নামল। মুষল বৃষ্টি গায়ে ছুচের মতো বিধতে থাকল। পেছনের চালাঘরের পাশ দিয়ে পুকুর ধারে এলো। জংলা পথ ধরে অন্ধকার দুর্যোগে কপালী বাবার ডেরার দিকে চলল। খালি পা পিছলে পিছলে যাচ্ছে, এটা ওটা পায়ে ফুটছে, ঝড়ের ঝাপটায় টাল খেয়ে পড়ছে, রাধার ভ্রূক্ষেপ নেই।
পৌঁছুল। দাওয়ার এক কোণে বিলাসী কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছ। মাঝে মাঝে অনেক রাত পর্যন্ত কপালী বাবা মায়ের ধ্যানে বসেন। মন অস্থির হলে বেশি বসেন। কদিন ধরেই মন খুব অস্থির। আজও বসেছেন।
বাবা!
কপালী বাবা বিষম চমকে ফিরলেন। আসন ছেড়ে দ্রুত কাছে এলেন। –এত ঝড়ে জলে তুই! এ, ভিজে যে শেষ হয়ে গেছিস। এত রাতে–
কথা থেমে গেল। মুখের দিকে চেয়ে বিমূঢ়। রাধার দুচোখ ধক ধ করে অলছে। এই মূর্তি এমন এলন্ত চোখ কপালী বাবা আর দেখেননি।
দাওয়া থেকেই কালীর দিকে খানিক ওই চোখের আগুন ঠিকরলো। বিড়বিড় করে রাধা বলল, আজ মামলার শেষ রাত, আমার জামা-কাপড় এনে দাও, ভিজে কাপড়ে ঢুকব না।
কপালী বাবা হন্তদন্ত হয়ে ভিতরে গিয়ে ওর কাপড় জামা গামছা এনে দিলেন। তারপর ঘরের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালেন।
মিনিট পাঁচ-সাতের মধ্যে ভেজা শাড়ি জামা বদলে রাধা ভিতরে এলো। ভিজে চুলের বোঝা পিঠ ছড়ানো। মায়ের মূর্তির খুব কাছে এসে চেয়ে রইল খানিক। তেমনি আগুনের গোলার মতো চোখ।
মেঝেতেই বসল। দু’চোখ মায়ের মুখের পর অপলক।
কপালী বাবা দাওয়ায় চলে এলেন। চারদিকে গাছ-গাছালির দরুন জলের ছ’টি আসে না। বাতাসের তাণ্ডবে ওগুলোর শ-শ। আর্তনাদ। রাধার ভেজা জামাকাপড় গামছা মেঝেতে পড়ে আছে। একে একে তুলে নিঙড়ে, টাঙানো দড়িতে ঝুলিয়ে দিলেন।
দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন।-মায়ের মুখের দিকে চেয়ে রাধা অস্ফুট স্বরে বলছে, কেন বললি? কেন বললি?
খানিক পায়চারি করে আবার এসে দাঁড়ালেন।
-কেন বললি? কেন বললি?
অনেকক্ষণ বাদে পা টিপে ঘরে এসে দাঁড়ালেন। শব্দ না করে চাটাইটা কোণ থেকে তুলে নিয়ে আবার বাইরে এলেন।
-কেন ব্লালি? কেন বলালি?
কপালী বাবা দাওয়ায় চাটাইটা পেতে বসলেন। চোখ বুজে তিনিও ধ্যানে বসতে চেষ্টা করলেন। অনেকক্ষণ চেষ্টা করলেন, কিন্তু ধ্যানে মন বসলই না। চোখ তাকিয়ে ঝুঁকে ঘরের ভিতরে তাকালেন। রাধা মেঝেতে ওপাশ ফিরে মায়ের পায়ের সামনে ঘুমোচ্ছ। কপালী বাবা আস্তে আস্তে উঠলেন। হাতঘড়ি দেখলেন। রাত বারোটার কাছাকাছি। ঝড়ো বাতাস কমেছে কিন্তু প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। পায়ে পায়ে রাখার কাছে এসে দাঁড়ালেন। যে বাহ কোমরের ওপর তাতে বীভৎস দাগরা দাগর দাগ। চামড়া ফেটে গেছে। ঘাড়ের পাশেও আঘাতের চিহ্ন। নিল আক্রোশে কপাল। বাবা ফুঁসছেন। পিঠের অবস্থা দেখতে পেলে কি করতেন কে জানে!
এই রাতে এমনিতে আর ঘুম আসবে না। দেয়ালের খোপ থেকে ছোট বোতলটা আর নিঃশব্দে এক গেলাস জল গড়য়ে নিয়ে আবার বাইরে এসে বসলেন।