একটু পরেই অস্ফুট আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হাতে নয়, চেলা-কাঠ তুলে এনে এক ঘায়ে পিঠের চামড়া দু ফাঁক করে দিয়েছে মনোহর। সেখানেই থামল না। চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে ওকে জল-কাদার উঠোনে ফেলে ঘুষি লাথি চড়। মুখে আঘাত করল না, জানে আঘাতে বিকৃত হলে শ্ৰনাথ পোদ্দারের চোখের রঙ ছুটে যাবে। মারতে মারতে নিজেই হাঁপিয়ে উঠল, কিন্তু ওর মুখ দিয়ে যাবে বলাতে পারল না। মারের সঙ্গে অশ্রাব্য সব কথা।–যাবি না? তিন ডাকাত তোকে খুবলে খেয়েছে, পেট হবার ভয়ে সাত তাড়াতাড়ি হাবড়া বোনাইয়ের সঙ্গে বে-তে বসেছিস, গান শেষ করেও বিন্দুবাসিনী আর রুমা সেনের বাড়ি থেকে বেরুতে তোর তিনপো ঘণ্টা এক ঘণ্টা দেরি হত কেন আমি বুঝি না–অতবড় বাড়ি থেকে এক তলায় নামলেই নিচিন্তি–ওই নিখিল রায় আর অজয় গুপ্তও তোক ছেড়েছে বলতে চাস? আমাকে নিয়ে সাত-সাতটা মরদকে ঠাঁই দিয়েছিল, তার ছিনাথদার বেলাতেই তুই মস্ত সতী হয়ে গেলি? আমার হিল্লে হয়ে যাবে সেটা কিছু নয়?
রাত্রিতে দাওয়ায় মদ নিয়ে বসেছে। রাধা ঘরে। বিলাসী খবর নিতে এসেছে রাধা পুজো করতে গেল না কেন। রাধা দেহটা দরকার সামনে হিঁচড়ে টেনে বলল, বাবাকেই পুজো করে নিতে বলা, শরীলটা ভালো না, বোলো কাল যাব
মদের নেশায় মনোহর তখন বসে থাকতে পারছিল না, তব চিৎকার আর গর্জন করে উঠেছে, খব-দার! ব-ই-লে দিস রা-আধা আল-কো-না-দিন যাবে নি–গেলে ওর আমি জা-আ-ন্ নেব।
বিলাসী ভয়ে পালিয়েছে।
পরদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দফায় দফায় মারধর করেও রাধাকে। যাবে বলতে চেষ্টা করেছে। না পেরে বিকেলের দিকে তাকেই লক্ষ্মীকান্তপুর ছুটতে হয়েছে। আগামী কাল অন্তত বউকে নিয়ে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে যেতে পারবে না বুঝতে পেরেছে। শ্ৰনাথ পোদ্দারকে যাহোক বলে বুঝ দিতে হবে।
অত মার খেয়েও সেই রাতে রাধা কপালী বার ডেরায় গেছে। জংলি কালীর পুজো করেছে। কি হয়েছে দশবার করে জিগ্যেস করেও কপালী বাবা জবাব পাননি। কেবল এক কথা, আমার মা কালীর সঙ্গে মামলা, জানতে চেও না।
রাতে ফিরে আবার মার। শ্রীনাথের কাছে ব্যঙ্গের চাবুক খেয়ে নিতাই সেকরার ডেরায় বসে প্রচুর মদ গিলে মনোহর ঘরে ফিরেছে। ওই চাবুক যে-কোনো সময় হিংস্র ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে মনোহর জানে। মত্ত অবস্থায় মারতে মারতে রাধাকে মাটিতে শুইয়ে ফেলেছে। সেই সঙ্গে গর্জন, কি দেখেছে ছিনাথদা তোর মধ্যে, তাই মেরে ফেলতি পারছি না, না হলে তোকে আমি খুন করে ভুয়ে পুঁতে ফেলতাম।
-দোতারবাবুর সঙ্গে ওসি অংশুমান ঘোষ এসে কপালী বাবার ডেরায় রাধার সঙ্গে দেখা করতে আসার আগে এই এক মাসের মধ্যে মনোহর আরো তিনবার রাধাকে শ্ৰীনাথ পোদারের বারুইপুরের বাগানবাড়িতে নিয়ে যাবার দিন ঠিক করে তিনবারই ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিবারের নৃশংস মার রাধা মুখ বুজে সহ্য করেছে, তার সর্বাঙ্গ ক্ষত বিক্ষত, তবু তার মুখ দিয়ে মনোহর ‘যাবে’ কথাটা বার করতে পারেনি। ওই মার খেয়ে প্রত্যেক রাতেই রাধার বেদম জ্বর আসছে। কিন্তু সন্ধ্যার পর মাথায় কাপড় দিয়ে শাড়িতে সর্বাঙ্গ ভালো করে ঢাকাটুকি দিয়ে জংলি কালীর পুজো করতে গেছে। সেখানে শাড়ি বদলাবার সময় বিলাসকেও কাছে থাকতে দেয়নি। মায়ের দাগ দেখলে আর্তনাদ কাব উঠবে মাঝে মাঝে পুজো শেষ করে আর ফিবতে পারে না ওই ঘরেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কপালী বাবা বরাবরই দাওয়ায় শোন। বিলাসী দাওয়ার আর এক কোণে পড়ে থাকে। রাধা কবে ফিরল কবে ফিরল না মনোহর টেরও পায় না। বউকে বশে আনাব তাড়নায় তার নেশা আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেছে, এমন নেশার জের কাটতে বেলা আটটা নটা বেজে যায়।
এবারে শেষ বারের মতো দিন ঠিক করে রাত আটটা নাগাদ মনোহর ঘরে ফিরেছে বিকেল থেকে আকাশ কালীবর্ণ, মেঘ গজরাচ্ছে, বিদ্যুৎ ঝলসাচ্ছে। সন্ধ্যায় আরো বেড়েছে। বৃষ্টি একবার নেমে গেলে আর বেরুতে পারবে না, তাই রাধা সন্ধ্যায় গিয়ে খানিক আগে পুজো সেরে চলে এসেছে। ঘরের ঠাকুর দেবতার ছবিগুলোর সামনে বসেছিল। পিছন থেকে এসে মনোহর দু-হাতে চুলের মুঠি ধরে বসা থেকে রাধাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল, হিড হিড় করে চার-পাঁচ হাত তফাতে টেনে নিয়ে এলো।–খুব বেশি মদ খায়নি, টলছে না, নৃশংস মূর্তি।
হিসহিস করে বলল, এবারে তোর একদিন কি আমার একদিন, কাল তোকে নিয়ে যাব আমি ছিনাথদাকে শেষ কথা দিয়ে এসেছি, কাল ভোর-ভোর তোকে নিয়ে বারুইপুর যাব। আমি সঙ্গে থাকব, তবু তোকে নিয়ে যাবার জন্য ভোর রাতে ছিনাথ পোন্দারের তিনজন বাছাই করা লোক আসবে
কথার ফাঁকে বাধা দেখল তার বুক পকেটে এক থোক একশ টাকার নোট উঁচিয়ে আছে।
দেখছিস কি, ছিনাথদার সঙ্গে শেষ ফয়সল করে এসেছি, টাকাও নিয়ে এসেছি। সকালে তুই মুখ বুজে সুড়সুড় করে না গেলে যারা আসছে তারা রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। তারপর তারা তোর গায়ে হাত দেবে, আমিই সেই ব্যবস্থা করে এসেছি। সকালে ন। পারলে ওদের সাহায্যে রাতের আন্ধারে তোকে আমি নিয়ে যাই হলপ করে এসেছি, এবার তোর বাপের সাধ্যি নেই আমাকে ঠেকায়। -যাবি কি যাবি না?
রাধা চেয়ে আছে।
প্রচণ্ড চড়ে মাথা ঘুরে খাটের কাছে মাটিতে পড়ল। মনোহর আবার দু’হাতে চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলল।–যাবি কি যাবি না?