দোতারাবাবু মাথা নাড়লেন, মনে হয় না, লোকটাও পাজি তবে ভীতু, কিছু সত্যি না হলে বাজার সরকারকে আমার কানে তোলার জন্য বলত না।
বৃষ্টি একটু ধরতে অংশুমান উঠলেন, চলুন, আগে রাধার সঙ্গে একবার দেখা করে আপনাকে বাড়িতে ছেড়ে আসছি।
জিপ থেকে নেমে মিনিট দুই জংলা পথ ভাঙলে কপালীবাবার ডেরা। উনি বাইরের দাওয়ায় বসেছিলেন। দোতারাবাবু চেনা লোক, সাদা পোশাক সত্ত্বেও থানার ওসিকেও চিনলেন। প্রায় আট বছর আগে সেই একবার জিপে করে রাধাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেছলেন। ডাকলেন, রাধা তোর কাছে কারা এলেন দ্যাখ, লণ্ঠনটা নিয়ে আয়
লণ্ঠন হাতে রাধা বেরিয়ে এলো। জঙ্গলের ডেরায় এ আর কতটুকু আলো, তবু চিনতে অসুবিধে হল না। ভালো করে দেখার জন্য দুজনেই একটু এগিয়ে এলেন, কিন্তু আবছা আলোয় এই ঠাণ্ডা গম্ভীর মুখ দেখে কতটকু আর বুঝবেন। একট ইতস্তত করে অংশুমান বললেন, তোর সঙ্গে দুই-একটা কথা ছিল।
রাধা চেয়ে আছে। কি কথা বোঝার চেষ্টা। বলল, বাবার সামনে সব কথাই হতে পারে, কিছু এনে পেতে দেব-বসবে?
-না ঠিক আছে। ইয়ে–তোর সম্পর্কে কি সব শুনছি, তোর স্বামী নাকি খুব অত্যাচার করছে?
তোমাদের কে বললে?
অংশুমান দোতারাবাবুর দিকে তাকাতে তিনি বললেন, নিতাই সেকরা আমার বাজার সরকার শঙ্কুকে বলেছে, তোকে ডেকে পাঠালা, এলি না, এখন বড়বাবুকে খোলাখুলি বল না কি হয়েছে, সব ঠিক হয়ে যাবে।
কপালী বাবা ধীর গম্ভীর মুখে সকলকে দেখছেন, রাখাকেও। অংশুমান বললেন, যা অনলায় তার কি সত্যি হলেও বল, থানায় নিয়ে গিয়ে দু’চারটে ঝাঁকুনি দিলেই ঠিক হয়ে যাবে
রাধা তবু জবাব দিতে সময় নিল একটু। তারপর খুব ঠাণ্ডা গলায় বলল, শোনো বড়বাবু, তোমাদের কিছুই জেনে দরকার নাই, শুধু জানি রাখে যা হতেছে সেটা কেবল মায়ের সঙ্গে আমার মামলা, তোমাকে কাউকে ধৰি নে যেতে হবে না, শাসাতে হবে না, মা শেষ পর্যন্ত কি করে আমি তাই দেখার অপেক্ষায় আছি, আমার জন্য তোমরা মনে কিছু ভাবনা রেখে না।
এবারে কপালী বাবা অধীর গলায় বলে উঠলেন, ভয়ংকর রকমের কিছু হয়ে যাচ্ছে আমিও বুঝতে পারছি, বিলাসীও বলছে–কিন্তু ওর কেবল এই এক কথা–এটা মায়ের সঙ্গে ওর মামলা কাউকে কিছু ভাবতে হবে না–আরে ভেবে ভেবে যে আমি অস্থির হয়ে গেলাম!
তার দিকে চেয়ে রাখা ওই এক কথাই বলল, ভেবে লাভ নেই, ভেব না।
৭. সকলের কল্পনার বাইরে
কিন্তু সকলের অগোচরে সকলের কল্পনার বাইরে প্রায় প্রত্যহ রাতে ভীষণ কিছুই ঘটে যাচ্ছে। রাগে আর মত্ত নেশায় তার কিছু আভাস কেবল নিতাই সেকরা পেয়েছে।
যেটুকু পেয়েছে ঘটছে তার থেকে ঢের বেশি।
দেড় মাস আগের সেই দুপুরে শ্রীনাথ পোন্দার ওই গান শুনে খেয়েদেয়ে চলে যাবার দিন সাতেক বাদে রাতের দিকে মনোহর পাইক খোশমেজাজে ঘরে ফিরেছে। মদও গিলে আসেনি। বলেছে, ছিনাথদা দারুণ খুশি তোর ওপর, আবার আমার ওপর তেমনি রাগ এমন সুন্দর বউটার অঙ্গে একটা গয়নার টুকরোও নেই কেন? আমি যত বলি রাধা গয়না পরতেই চায় না, শুনতেই চায় না। বলল, দেখি পরতে চায় কিনা, আমি পরাব। আজ বেস্পতিবার, এই রোববার তার বারুইপুরের বাড়িতে আমাদের নেমন্তন্ন, দিন কয়েক থেকে আনন্দ করে আসব।
রাধা তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠেছে, তার লক্ষ্মীকান্তপুরের বাড়িতে নয় কেন-সেখানে তার বউ ছেলেমেয়ে আছে তাই আনন্দ করতে অসুবিধে হবে বলে?
মনোহর থমকেছে একটু। তারপরেই বিরক্ত।”তুই কি থেকে কি বুঝিস ঠিক নেই–আরে নিজের এলাকায় থাকলে দু’দও ফুরসত মেলে তার। দিন-রাত লোক আনা-গোনা ভ্যাজর ভ্যাজর লেগেই আছে, দুদিন ভালো করে বিশ্রাম নিতে হলেও ছিনাথদা ঘর ছেড়ে পালায়। বাজে রাগ করিসনি–এর মধ্যে আমি তোকে খান দুই ভালো শাড়ি আর জামাটামাও কিনে দেব।
এমনি একটা সময় আসছে রাধা জানতই, তবু রাগে ঘৃণায় বিবর্ণ। শুরুতেই প্রচণ্ড ঘা না বসালেই নয় বলে উঠল, আমি কোথাও যাবনি তুমি চুলোয় যাও, এত নিচ এত হীন তুমি?
মনোহরের মাথায় রক্ত ওঠার মতো এ-ই যথেষ্ট। এগিয়ে এলো। গলা টিপে ধরল। সজোরে কয়েকটা ঝাঁকুনি দিল। দম বন্ধ হয়ে রাধার দু’চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসার উপক্রম–যাবি না? ছিনাথদা ডেকেছে আর তুই যাবি না? আমি তার খাই পরি, সে আমাকে রাজার হালে রেখেছে–দুদিনের জন্য আদর করে ডেকেছে আর তুই যাবি না? মাটিতে আছড়ে ফেলল। কিল চড় লাথি। রাধা নিস্তেজ। এতেই ঢিট হয়েছে ধরে নিয়ে মনোহর নিশ্চিন্ত। মদ নিয়ে দাওয়ায় বসার আগে ট্রাঙ্ক খুলে তাকে এক পাঁজা একশ টাকার নোট রাখতে দেখল রাধা। এত টাকা কোথা থেকে এসেছে কেন এসেছে বুঝতে এক মুহূর্ত সময় লাগল না।
পরদিন। রাধা রোজই সন্ধ্যার আগে রাতের রান্না সেরে রাখে। সন্ধ্যার পর কপালী বাবার ওখানে যায়। রাধা হেঁসেলে। খানিক আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। একটা বড় একটা ছোট মোড়ক হাতে হাসি হাসি মুখে মনোহর সেখানে এসে দাঁড়ালো। গত রাত থেকে এ পর্যন্ত এই প্রথম কথা।–কাল খামোখা এমন রাগিয়ে দিলি–ধর, দুখানা খুব সুন্দর শাড়ি এনেছি, জামা দুটোও দামী–তোর পছন্দ হবে।
রাধা ঘুরে তাকালো। উঠল। মোড়ক দুটো হাত থেকে নিল। হেঁসেলের জানালা দিয়ে ও দুটো জল-কাদার আঁস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে আবার উনুনের কাছে বসল।