রাখার চোখে জড়তা নেই, লোকটার দিকে সোজা তাকালো। তারপর ঘরের কোণের কাপড়ে ঢাকা হারমোনিয়ামটার দিকে। বুঝে নিয়ে মনোহর ব্যস্ত হয়ে হারমোনিয়ামটা তুলে খাটের ওপর রাখতে গেল।
-ওখানে নয়।
দু’হাতে হারমোনিয়াম নিয়ে মনোহর দাঁড়িয়ে গেল। কোণ থেকে গোটানো মাদুরটা এনে রাধা মেঝেতে পাতলো। মনোহর হার মোনিয়াম রাখতে পিছনে পা মুডে রাধা নিজের ঢঙে বসল। যা’মনে এলো সেটা ফকির সাহেবের শেখানো গান।
‘রাম-রহিম না জুদা করো, দিলকো সাচ্চা রাখো জী,
হাজী হাজী করতে রহহ, দুনিয়াদারি দেখো জী।
যব য্যায়সা তব ত্যায়সা হোয়ে সদা মগমে রহেনা জী,
মাটিমে ইয়া বদ বনি হায় ইদ সদা রাখনা কী।
তব, যব সেকো ফর রহহ ভাই,
যিস যিস কামমে মানা জী,
ক্যা জানে কব দম ছুটেগা, উসকো নেহি ঠিকানাজী।
সমঝদার শ্রোতার আড়ালে দুটো হাঙরের চোখ তার মুখে বুকে ওঠা-নামা করছে। রাধা এক-একবার সোজা তাকিয়ে দেখছে, চোখে চোখ রেখেই শেষ করল। তারপর উঠে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে মনোহলের আরক্ত চক্ষু। আরো গাইবার জন্য ধমকে উঠতে যাচ্ছিল, হাত তুলে শ্রীনাথ তাকেই খামালো। আবার কেন, এই একটাই হজম হয়েছে। গানের ভিতর দিয়ে ও কি উপদেশখানা ঝাড়ল মগজে ঢুকেছে? হাসিমাখা চাউনি রাধার দিকে, বলল, দুকান ভরে গেল, এমন নিটোল মিষ্টি গলা কমই শুনেছি।
খেয়ে দেয়ে আধ-ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম করে মানী অতিথি চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মারমুখো মূর্তি মনোহরের, এমন একটা লোক সেধে ঘরে এলো, আমার সব ভবিষ্যত ওর হাতে–আর তুই কিনা সর্বক্ষণ বোবা হয়ে থাকলি! ছ’ছটা বডি-গার্ড নিয়ে ঘরে, সক্কলের কাছে লুকনো অস্ত্র থাকে, বাড়ি পর্যন্ত প্লেন ড্রেসের পুলিশের লোক পাহারা দেয়, আর তুই কিনা তার সঙ্গে হেঁজি-পেঁজি লোকের মতো ব্যাভার করলি?
রাধা তার দিকে অপলক চেয়ে রইলো খানিক। তারপর বলল, ওজন্য চিন্তা রেখোনি, যতটা আশা করেছিলে তোমার মানী অতিথি তার থেকে ঢের বেশি মুগ্ধ হয়ে এখেন থেকে বেরিয়েছে।
মনোহর থমকালো একটু। কথাগুলো মগজে ঢুকতে একটু হেসে উঠেই আবার খেঁকিয়ে উঠল, রসের কথা তত কম জানিস না, ছিনাথদার সামনে মুখ সেলাই করে থাকলি কেন?
.
বর্ষা কাল। মাঝে মাঝে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। সেই বৃষ্টি মাথায় করে দোতারাবাবু অংশুমানের কোয়ার্টারস এসে উপস্থিত। দুর্যোগে সন্ধ্যা না হতে রাত্তির। রিকশয় এসেছেন, গায়ে বর্ষাতি আর সঙ্গে ছাতাও আছে। ভেজেননি। তবু এ-সময়ে তাকে দেখে অংশুমান জিগ্যেস করলেন, কি ব্যাপার, এই জলের মধ্যে?
এসে গেলাম রে ভাই, ক’দিন ধরে মনটা উতলা হয়ে আছে, ভাবলাম তোমার কানে কথাটা তুলে দিই। সুচারু দেবীকে বললেন, আগে এক কাপ চা দাও।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে চা আসতে দোতারাবাবু মন কেন উতলা সেটা একটু বিস্তৃত করেই বললেন।
-দেড় মাস যাবত রাখার ওপর ভয়ানক অত্যাচার শুরু হয়েছে। অত্যাচার করছে তার স্বামী মনোহর পাইক। ভীষণ মারধর করছে। লক্ষ্মীকান্তপুরের নামকরা জোতদার নাথ পাোরের রাখার ওপর চোখ পড়েছে। একদিন এসে দু-তিন ঘণ্টা থেকে রাধার গান শুনে খেয়ে দেয়ে গেছে। সাত দিন না যেতে শ্রীনাথ রাধাকে নিয়ে যাবার জন্য বার বার নেমন্তন্ন করেছে। তার কাছে মনোহরের টিকি বাঁধা, সে ওকে দিয়ে অনেক রকমের কাজ করায়, টাকাও দেয়। দোতারা বাবুও যতটুকু জানেন, মনোহর লোকটা পাজির পা-ঝাড়া, বছর তেত্রিশ মাত্র বয়েস, নেশায় চুর হয়েথাকে। নিতাই সেকরা তার প্রাণের বন্ধু, রাধাকে বিয়ে করাব জন্য একসময় সে-ও ক্ষেপে উঠেছিল। মদ খেয়ে তার কাছে গলগল করে সব কথা বলে। দোতারাবাবুর বাজার সবকারের সঙ্গে আবার নিতাই সেকরার খাতির। রাধার বিপদ আঁচ করে সে-ই বাজার সরকারকে চুপিচুপি বলেছে দোতারাবাবুকে জানাতে, সে জানে বাবু রাধাকে খুব স্নেহ করে।রাধা নিজের বিপদ বুঝেই বার বার গোঁ ধরে শ্রীনাথের নেমন্তন্ন বাতিল করছে, আর মনোহর ক্ষেপে গিযে স্ত্রীর ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। নিতাই সেরা নাকি বলেছে, বউকে এনে দেবার টোপ ফেলেও নাকি মনোহর পাইক তার কাছ থেকে থোকে থোকে টাকা লুটেছে, কিন্তু বউকে আনতে পারছে না বলে এখন তারও মেজাজ গরম। গত রাতেও নাকি নেশা করে মনোহর নিতাইয়ের কাছে বুক ঠুকে বলেছে, ও না যায় তো ওর আধমরা লাশ যাবে শ্রীনাথ পোদ্দারের কাছে, আরো বলেছে, তিন তিনটে ডাকাতের হাত দিয়ে ঘুরে এসে এখন সতীপনা দেখাচ্ছে, শ্রীনাথের কাছ থেকে ছিবড়ে হয়ে ফিরে এলে আর যাদের লোভ আছে ওর ওপর তাদের কাউকেই বঞ্চিত করবে না–তবে ওকে পিঁপড়ে দিয়ে খাওয়ানোর পুরনো হিসেব মিটবে। কবে নাকি রাখা ওকে পিঁপড়ের ভাইয়ের ওপর শুইয়ে দিয়ে শেষ করে এনেছিল।
সুচারু দেবী আঁতকে উঠেছেন।–এ কি সব্বেনেশে লোক গো এমন আবার হতে পারে নাকি? রাধার মুখে তো কখনো এতটুকু বিকার দেখিনি, তবে মেয়েটা অনেক দিন আসে না অবশ্য–কিন্তু সত্যি হলে কি হবে?
একটু ভেবে অংশুমান বললেন, নকশালদের হুমকি খেয়ে নাথ পোদ্দার নিজেই তো এখন চুপসে আছে। নকশালদের ওপর অংশুমান তখন দারুণ কুদ্ধ। ওদের হাঙ্গামার জন্যেই তাঁর বদলী প্রমোশন সব আটকে আছে। বললেন, তবে শ্রীনাথ পোন্দারের এই দোষের কথা অনেক শোনা আছে, কিন্তু ওই নিতাই সেকরা আবার নিজের লোভে মনোহরকে ঘায়েল করতে চায় না তো?