ও-সব কোনো ওজর আমি শুনব না, যারা আছে তাদের ব্যবস্থা আমি যেভাবে পাৰি কবছি, আমার বউ রান্নায়ও দৌপদী এটা জেনে রাখো।
বাহুর অস্বস্তি ভুলে এবার রাধার চোখে মুখে অন্য সংকট। এই বেলা সাড়ে দশটায় মাছ দূরের কথা আনাজ পর্যন্ত যোগাড় করা যাবে কিনা সন্দেহ। এই লোক বলে কি?
অতিথির ঘনিষ্ঠ দু’চোখ আবার তার মুখের ওপর।গাধাটার কথা শুনলে, এই অবেলায় এসে এখন আমি তোমাকে বাড়তি সাত জনের হাঁড়ি ঠেলতে পাঠাব! বাহু থেকে হাত নামালো। বাইরের দিকে চেয়ে হাঁক দিল, এই বিশে, এদিকে আয়।
জোয়ান চেহারার একজন ছুটে এলো। সিল্কের পাঞ্চাৰি পকেট থেকে মানি ব্যাগ বার করে একটা একশ টাকার নোট তার হাতে দিল।–আমাকে এখন এর ছাড়বে না, তোরা তিনজন তিনজন করে জয়নগর থেকে খেয়ে আয়, এক ব্যাচ এলে অন্য ব্যাচ যাবে
মাথা ঝাঁকিয়ে বিশে চলে গেল। এই ফাঁকে রাধা আস্তে আস্তে দুপা সরে এসেছে। এনাথ এগিয়ে গিয়ে অন্তরঙ্গজনের মতো এক হাতে আবার ওর কাঁধে বেষ্টন করে বলল, মনা ছাড়বে না। আগেই জানতাম, চলো, কিন্তু শুধু খাওয়ালে চলবে না, গান শোনাতে হবে
নিশ্চয় শোনাবে, এসো এসো। ব্যস্ততা মনোহরের।
রাধার সর্ব অঙ্গ অবশ অবশ লাগছে। আবার জ্বালাও, গায়ে পিঠে যেন বিছে দংশাচ্ছে।
জুতো জোড়া দাওয়ায় রেখেই ভিতরে ঢুকল। দেব-দেবীর সারি সারি ফোটো দেখে বলে উঠল, বা-ব্বা, কেউ যে বাকি নেই দেখছি।
হা হা করে হেসে মনোহর যোগ দিল, আর বলো কেন দাদা, ভক্তির ঠেলায় অস্থির হয়ে গেলাম
সঙ্গে সঙ্গে অতিথি ধমকে উঠল, তুই থাম! চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্যে এমন বউ পেয়েছিস!
–ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে-এবার ঠাণ্ডা হয়ে বোসো।
রাধার বরাবর মেঝেতে শুয়ে অভ্যেস, কিন্তু বিয়ের পরেই এ-ঘরে পালঙ্ক এসেছে। তার ওপর শৌখিন বেডকভার পাতা। এব্যবস্থা যার, মাসের মধ্যে ইদানিং প্রায় তিরিশ দিনই নেশার ঘোরে তার বাইরের দাওয়ার ওপর শয়ন।
টান করে পাতা বেডকভারটা দু-তিনবার হাতের চাপড়ে ঝেড়ে মনোহর বলল, বোসো দাদা, বোসো–এমন ঘরে তোমাকে বসাতেও লজ্জা।
অতিথির ভ্রুকুটি।–ফের!
–আর বলব না, আর বলব না, রাধা দাদাকে আগে বেশ ভালো করে এক গেলাস নেবুর সরবত এনে দে
এতক্ষণে রাধার মুক্তি। কপালে মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। দাওয়ার ডান দিকে বিচ্ছিন্ন হেঁসেল। সেখানে এসে শাড়ির আঁচলে মুখ মুছল।
তক্ষুনি হন্তদন্ত হয়ে সামনে মনোহর। বুকে মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে জিগ্যেস করল, মাছ কি আছে?
–চার পাঁচ টুকরো হবে।
–ওতেই হবে, আনাজ?
–আছে।
–বেশ, তুই সরবত নিযে যা আমি চট করে মাংসটা আর কিছু মষ্টি নিয়ে আসছি।
-এত বেলায় মাংস কোথায় পাবে?
-কি বলিস ঠিক নেই, মোছলমানদের ঘরে ঘরে মুরগী, আর মাংস পাবনি?
এবারে রাধা আস্তে আস্তে ঘাড় উঁচিয়ে তাকালো। এই হেঁসেলে কখনো মুরগী ঢোকেনি।
–যতো সব! যেমন অসহিষ্ণু তেমনি বিতৃষ্ণা।–যে মানুষ এসেছে তার জন্যি দরকার হলে গোরুর মাংস ঢুকবে! বুঝলি? ঠিক আছে, রাধব তো আমি আর খাওয়া হবে দাওয়ায় বসে হেঁসেলের পিছনে কাঠ জ্বেলে যদি রাধি তাতে তো আর কিছু অশুদ্ধ হবে না। এখন সরবত নিয়ে তাড়াতাড়ি যা–একলা বসে আছেন, পরে তোর ছুচিবাই আমি ছাড়াচ্ছি–
ছুটে বেরিয়ে গেল।
একটু বাদে শাড়ির আঁচল বেশ করে বুকে পিঠে জড়িয়ে রাধা সরবত নিয়ে ঢুকল। শ্রীনাথ খুশি মুখে হাত বাড়িয়ে সরবত নিল। হাতে আঙুলের স্পর্শ ইচ্ছাকৃত মনে হল। খাটের পাশটা দেখিয়ে বলল, বোস।
রাধা মৃদু স্বরে বলল, রান্নাঘরে যাব
-তোরা এত ব্যস্ত হলে আমি না খেয়েই চলে যাব–বোস।
অগত্যা রাধা যতটা সম্ভব পালঙ্কের এদিক ঘেঁষে বসল। হাসি হাসি মুখে সরবত খাচ্ছে। চোখ দুটো রাধার মুখে বুকে সর্বাঙ্গে বিঁধছে।
-মনা কোথা গেল।
-কি আনতে টানতে
–দ্যাখ, তত অসময়ে এসে কি হুজ্জোতে ফেললাম তোদের। …গানে তো তোব বেশ নাম শুনি, দুই-একবার আমাদের লক্ষ্মীকান্ত পুরেও গেছলি শুনলাম?
–অনেক আগে–
–কেবল ভক্তির গানই করিস বুঝি?
চুপ করে থাকাটুকুই জবাব। সোজা না তাকিয়েও দু’চোখের ওঠা-নামা টের পাচ্ছে।
–বিয়েতে তোকে হার দিয়েছিলাম, পরিস না?
–তোলা আছে।
-হাতেও তো কেবল লোহ ছাড়া কিছু দেখছি না, মন টাকা তো আমার থেকে কম পায় না, গড়িয়ে দেয় না কেন? ওকে আমি আচ্ছা করে বকব
এবারে রাধা স্পষ্ট করেই বলল, আমি গয়না পরি না।
চেয়ে রইলো। তারপর হেসে রসিকতা করল, গয়না না পরলেও তুই কম সুন্দর না, তবু মনার তো তোকে সাধ করে পরানো উচিত।
মনোহর ফিরতে রাধা উঠে গেল। রাধার রান্না মোটামুটি হয়েই গেছল। আর যেটুকু করল তাতে আধ-ঘণ্টাও লাগল না। মনোহর হেঁসেলের পিছনেই মুরগীর মাংস চড়িয়ে তাকে ভাগিদ দিল, তুই ছিনাথদার কাছে গিয়ে বোস্–দুই একটা গান-টান শোনা, এদিক আমি দেখছি।
তবু ওর গড়িমসি ভাব দেখে মনোহরই এক-রকম ঠেলে নিয়ে এলো। –নে দাদাকে দুই একখানা গান শোনা।
রাধা সোজা তার দিকে তাকালো। এখন গান আসবে না।
অবাধ্যতার জন্য তার মুখে সেই থেকে হাসি নেই লক্ষ্য করে মনোহর হাড়ে হাড়ে চটছিল। রাগ আর চাপতে না পেরে খেঁকিয়ে উঠল, কার সামনে বলছিস জানিস না–এত দেমাক তোর। গানের বাবা আসবে
-মনোহর। চাপা গজনই করে উঠল শ্রীনাথ, ফের ওর সঙ্গে এভাবে কথা বলবি তো আমার হাতে থাপ্পড খাৰি। রাধার দিকে চেয়ে খুব কোমল গলায় বলল, এত দূর থেকে এলাম, একটা গানও হবে না? খুব কষ্ট হলে অবশ্য থাক–