রাধা এর পরেও স্থির নির্বাক। তবে সোজা চোখে চোখ রেখেছে।
রাতে মদ খায়নি। কাছে এসে আদর করতে চেষ্টা করেছে। বলেছে, তুই সত্যি কি সুন্দর, আমি একটা পাষণ্ড।
রাখা মুখ খুলেছে।-আমার শরীলে যন্ত’ হচ্ছে, সরে যাও!
পরের দুদিন বা দুরাতেও মদ খায়নি। তার সোহাগের নিষ্ঠুরতা রাধা মুখ বুজে সহ্য করেছে।
দিনের পর দিন এরপর ওই চালাঘরে মাঝেসাজে কেবল চালের বস্তা আসতে দেখেছে। অন্য কিছু না। বেশির ভাগ দিন ফাঁক। চালাঘরে দু-চাকার ঠেলাটা পড়ে থাকে। রাধা বোঝে এ শুধু ভয়ে, আর কোনো কারণে নয়। তার গুরু শ্ৰনাথ পোদ্দার এই লোকের থেকে ঢের চালাক।
তারপর আবার যে-কে সেই। দেদার মদ গেলে। সত্যি না মারলেও কথায় কথায় তেড়ে মারতে আসে। অশ্রাব্য গালাগাল দেয়। রাধা যতটা পারে চুপ করে থাকে। মদ গিললে কথা বলা ছেড়ে ধারে কাছেও ঘেষে না। মদে বেহুশ হয়ে বেশির ভাগ রাতই ওই লোক দাওয়ায় পড়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোয়। দাওয়ার ওপর ঢালু টালির ছাদ থাকায় নোদ-জলেও ঘুমের ব্যাঘাত হয় না।
কপালী বাবা ফিরেছেন আট মাস বাদে। রাধা নিজে কিছু না বললেও অশান্তি আঁচ করেছেন। বলেছেন, তোক তো একটুও ভালো দেখছি না, ছোঁড়াটা বেয়াড়া হয়ে উঠেছে?
রাধা বলেছে, ও নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না, তোমার মায়ের পুজো যেমন করছি তেমনি করে যেতে অনুমতি দাও।
–ঠিক আছে ঠিক আছে, আমার মা কি রকম, তোর নয় নাকি?
রাধা জবাব দেয়নি। এতদিন বাদে ফিরে কপালী বাবা মনোহরের সম্পর্কে যেটুকু খবর সংগ্রহ করতে পেরেছেন তাতেই বিচলিত। শুধু মুখে নয়, পুজোর কাপড় জামা বদলাবার সময় রাধার গায়ে পিঠেও বিচ্ছিরি মারের দাগ দেখেছে বিলাসী তা-ও বলেছে। তিনি ফেরার পর মনোহর দেখা করতে আসেনি, পথে তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে। স্তম্ভিত হয়ে পরে তিনি রাধাকে বলেছেন, ছোঁড়াটার তো পাখা গজিয়েছে দেখছি–ও তো মরবে। আমি তোর কথা বলে ধমক লাগাতেই মুখের ওপর জবাব দিল, তোমার উপকার ছাড়া কখনো অপকার করিনি, আমার ব্যাপারে আর নাক গলাতে এসো না!
-সত্যি এসো না বাবা, কঠিন গলায় রাধা বলেছে, মায়ের হাতে ছেড়ে দাও, দেখি কোন্ পর্যন্ত টানে।
এত অশান্তি আর যন্ত্রণার মধ্যেও রাধা গান ছাড়েনি। আগের থেকে কম যদিও, তবু ডাক এলেই গাইতে যায়। গান যখন করে সব ভুলে যায়। দোতারবাবু রুমা সেনবিন্দুবাসিনী দেবী এবং আরো কেউ কেউ নিয়মিত টাকা-কাপড় দ্যান। ঘরের বউ তার টাকার মুখাপেক্ষী নয়, মনোহর এও বরদাস্ত করতে চায় না। প্রায়ই হুমকি দেয়, ভিক্ষে নিতে লজ্জা করে না, এরপর আমি তোর গানই বন্ধ করে দেব।
রাখা জংলি কালীর পুজো সেরে বা কোথাও থেকে গান গেয়ে রাতে যখন ফেরে, সময়ের বা টাকার হিসেব নেবার জন্য ইদানীং মনোহর কোনদিনই সজাগ থাকে না। তার নেশার মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে চলেছে। টালির ছাদের নিচে দাওয়ার ওপর বেহুশ হয়ে পড়ে থাকে। মুখ দিয়ে কেনা বেরুতে থাকে। দাওয়া থেকে কেউ তাকে ঠেলে উঠোনে ফেলে দিলে টের পাবে না বোধহয়।
*
মানুষটাকে সামনে দেখা মাত্র রাধার বুকটা ধক করে উঠল। মন বলে উঠল, এবার বিপদের দিন এলো।
মনোহরের গুরু নামজাদা জোতদার লক্ষ্মীকান্তপুরের শ্রীনাথ পোদ্দার উঠোনে হাসি-হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। এমন ভাগ্যের জোয়ারে বিহ্বল মনোহর পাইক সটান উপুড় হয়ে শুযে তার জুতোয় মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে গা ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়ালো। ডেরার বাইরে থেকে শ্রীনাথের জনা ছয় জোয়ান ব্যসেব সঙ্গী উঁকি দিচ্ছে।
রাধা উঠোনেব তারে শাড়ি মেলছিল, তাকে দেখে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে গেছে।
আনন্দে আত্মহারা মনোহর বলে উঠল, হাঁ করে আছিস কি, ছিনাথাকে এরই মধ্যে ভুলে গেলি? পেন্নাম কর, পেন্নাম কর আজ আমাদের ভাগ্যি সুয্যি কোন্ দিকে উঠেছেল–অ্যাঁ?
শ্রীনাথ পোদারের ফর্সা মুখে টিপটিপ হাসি। হাসি-ছোঁয়া চাউনি রাধার মুখের ওপর। দেড়বছর আগে সেই বিয়ের সময় দেখেছিল। বধূবেশে তখনো বেশ ভালোই লেগেছিল। কিন্তু আটপৌরে বেশের এই রূপ যেন আবিষ্কারের জিনিস।
রাধা শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো। চোখ দুটো একবার শুধু পরম সম্মানের অতিথির চোখের সঙ্গে মিলেছে। কাছে এসে প্রণাম করার জন্য কুকতে অতিপরিচিত আত্মজনের মতো শ্রীনাথ দু-হাতে তার দুই বাহু ধরে টেনে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিল। বাহু ধরাই আছে, চপল নিবিষ্টতায় মুখখানা দেখল একটু। বলল, অত পেয়ামের ঘটা আমার ভালো লাগে না। মনোহরের দিকে ফিরল, তোর মিষ্টি বউয়ের গানের প্রশংসা আমি লক্ষ্মীকান্তপুরে বসেও শুনেছি–কিন্তু তোর মতো রাসকেলের হাতে পড়েও এরই মধ্যে আরো এত মিষ্টি হয়ে গেল কি করে!
রাধার বয়েস এখন সাতাশ শুরু হয়েছে। এত অশান্তি আর যন্ত। সত্ত্বেও মা যেন আকেল দেবার জন্যেই ওর যৌবনে স্থির জোয়ার নামিয়ে রেখেছে–চলতে ফিরতে উছলে ওঠে।
দুই বাহুর চামড়া শাডি জামা সত্ত্বেও চিড়বিড় করছে। হাত দুটো এখনো নামেনি।
মুরুব্বির রসিকতার কথায় মনোহরের মুখে হাসি আর ধরে না। চলো চলে, ভিতরে বসবে চলো, আজ এসে গেছ যখন সহজে ছাড়ছি না-খেয়ে যেতে হবে।
শ্রীনাথের হাসিতে স্নেহ ঝরল, আজ হঠাৎ এসে গেছি, ও-সব হাঙ্গামায় দরকার নেই, আর একদিন হবে’খন, সঙ্গে ছ’জন লোক আছে–