লজ্জা পাচ্ছিলাম। কিন্তু ভালও লাগছিল। লেখক মানেই এ ধরনের পুরস্কারের আশা তার রক্তের মধ্যে। এরপর নিজের পরিচয় দিলেন। এবং আমার প্রশ্নে প্রশ্নে সেটুকু বিস্তৃত হল। নাম অংশুমান ঘোষ, তাঁর বাবা দিল্লি পুলিশের বড় চাকুরে ছিলেন, একমাত্র ছেলেকে আই-পি-এস পরীক্ষায় বসিয়েছিলেন। সেই পরীক্ষার জোরে তিনি লাস্ট হয়েছিলেন কি দুই একজনের আগে ছিলেন সেটা জানা যায়নি। নিজের শরীর স্বাস্থ্যের গুণে কনস্টেবলের চাকরি একটা হতে পারত, বাবার সুপারিশের জোরে কলকাতায় পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে চাকরি জীবন শুরু। তাঁর পিতৃদেবের বিবেচনায় পুলিশের চাকরিই সর্বোত্তম, পরে সুযোগ সুবিধে মতো ছেলেকে দিল্লিতে টেনে নিতে পারবেন এমন আশা হয়তো মনে ছিল। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি। তার ওপরে তিনটি বোন। বাবা তাদের প্রত্যেককে বেশ বড় ঘরে বিয়ে দিতে পেরে নিশ্চিন্ত। তাঁর একমাত্র দুশ্চিন্তা ছিল এই অপদার্থ ছেলের জন্য। অতএব তাঁর এই বাড়ি আর সঞ্চিত বিত্তের বেশির ভাগই ছেলের ভাগ্যে এসেছে। শেষবয়সে বাবার কলকাতায় এসে বসবাসের ইচ্ছে ছিল বলেই এই বাড়ি। কিন্তু কেবল গৃহ-প্রবেশই করেছিলেন, বাস করার সময় মেলেনি। ছেলের চাকরির সময় বাড়িটা বারো না চৌদ্দ বছরের লিজ দেওয়া ছিল। লিজ খালাস হবার পরেও এখানে বাসের সুযোগ হয়নি, কারণ তখন বেশির ভাগ সময়ই তিনি বাইরে পোস্টেড। মাঝবয়েস পর্যন্ত তো ওসি’ গিরিই করেছেন, কোয়াটার্স-এ থেকেছেন। তারপর তাঁকে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে টেনে নেওয়া হয়েছিল, যখন যেখানে ছিলেন ভালো আস্তানাই জুটেছে। শেষের বছর দুই-আড়াই আরো একটু উচ্চ পদস্থ হতে পেরেছিলেন, রিটায়ারমেন্টের পরে তাঁর দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের ভাড়াটেকে বুকে দাগা দিয়ে এই ফ্ল্যাট থেকে তুলে নিজে এই প্রথম পৈতৃক বাড়িতে স্থিতি লাভ করেছেন। বছর পাঁচ-সাত হল স্ত্রী মারা গেছেন। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। জামাই মস্ত বড় কোম্পানির বড় দরের এনজিনিয়ার, ছেলেও এনজিনিয়ার, জামাই-ই তাকে নিজের কোম্পানিতে টেনেছে এবং পদস্থ করেছে।
ভদ্রলোকের কথাবার্তা গম্ভীর গোছের, কিন্তু বেশ সরস।
হেসে বললাম, ছেলে জামাই দুজনেই এনজিনিয়ার, আপনার তাহলে পুলিশের চাকরির ওপর তেমন টান নেই?
-–কি যে বলেন, এদেশের মানুষ পুলিশকে কি চোখে দেখে আমার জানতে বাকি! আমার নিজের বিয়ের ব্যাপারে মশাই বাবা মায়ের পছন্দের তিন-তিনটি মেয়ের বাপ ছেলের পুলিশে চাকরি শুনে পিছু হটে গেছল। পুলিশের মেয়ে শুনে আমার এই জামাইয়ের বাপও পিছু হঠার মতলবে ছিল, মেয়েটাকে দেখে জামাই বাছাধন একটু মজে না গেলে এ-বিয়ে হত কিনা সন্দেহ।
আমি হেসে উঠেছিলাম। তিনিও হেসেই বললেন, সত্যি যা তা সত্যি, আর ছেলের বিয়েও কি পুলিশ বাপ দেখে হয়েছে–হয়েছে তার বিদ্যের ছাপ আর বড় কোম্পানির ভালো চাকরি দেখে। বউমাকে একদিন সে-কথা বলতে সে তো লজ্জায় বাঁচে না।
যতটুকু দেখেছি ভদ্রলোকের বউমাটি বেশ সুশ্রী, আর মেয়েটিকে সুন্দরীই বলা চলে। চাকরি ক্ষেত্রে আমি মোটামুটি পদস্থ সাংবাদিক ছিলাম, সেই সুবাদে কিছু পুলিশ অফিসারের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ও আছে। তাঁদের বিনয় এবং শিষ্টাচার নিয়ে কটাক্ষপাত করছি না, কিন্তু ভদ্রলোকের অন্তরঙ্গ হবার মতো একটু বিশেষ গুণ আছে। এখন অন্তত একে রাশভারী বা জাঁদরেল পুলিস অফিসার বলে মনে হচ্ছে না। হতে পারে কর্মক্ষেত্রে তাই ছিলেন, কিন্তু ভিতর সরস না হলে প্রথম আলাপে সৌজন্যের পালিশই বেশি চোখে পড়ত।
গল্প থামিয়ে জিগ্যেস করলাম, চা হবে কি কফি আগে বলুন?
–দুটোর একটা হবেই? তাহলে চা-ই বলুন, আর সেটা আসার আগে আপনার এই পর্দাটা ফেলে দিন, আমার বারান্দা থেকে হীরু ব্যাটার বাবার চোখে না পড়ে। হাসছেন।
-হীরু কে?
হীরু হল হীরেন্দ্রচন্দ্র দাস, ছেলেবেলায় ছিল চাকর, প্রমোশন পেতে পেতে রান্নার ঠাকুর হয়েছে, বাজার সরকার হয়েছে, ড্রাইভার হয়েছে, আর হালে মেয়ের আস্কারা পেয়ে এখন আমার গার্জেন হয়ে বসছে–দিনে কত পেয়ালা চা খাই মেয়ের কাছে রিপোর্ট করে।
বুঝলাম এ সেই না-বাবু না-চাকর গোছের লোকটি। জিগ্যেস করলাম, খুব বেশি খান নাকি?
কোথায় বেশি, দিনে রাতে পাঁচ-ছ কাপ–তবে ইদানীং গলার ট্রাবলের অজুহাতে একটু বেশি হয়ে যাচ্ছিল–
চা বলে এলাম। প্রথম বাক্যালাপে গলার ট্রাবলের দরুন লেকে বেড়াতে যেতে পারছেন না বলেছিলেন মনে পড়ল। আর সামনের বাড়ির অমর গাঙ্গুলীর ভাষায় সেই অজুহাতে সকালেই গরম জল সহযোগে ব্রাণ্ডি চলছিল–এ নাকি কোণের বাড়ির কনট্রাক্টর দত্ত সাহেব স্বচক্ষে দেখে গেছেন। জিগ্যেস করলাম, আপনার গলার কি ট্রাবল?
-কে জানে, গলার স্বর মাঝে মাঝে কেমন ফ্যাসফেসে হয়ে যায়, আর ভিতরে কি-রকম চাপ চাপ লাগে–মেয়ে শুনে থ্রোট স্পেশালিস্টের কাছে টেনে নিয়ে গেল, তিনি দেখেশুনে বললেন কিছুই না, ফ্রিজের জল বা ঠাণ্ডা জিনিস কম খাবেন। একটু যত্নটত্ন করলে অবশ্য কমে যায়, তা আমি যত্নটা বেশির ভাগ চায়ের ওপর দিয়েই চালাচ্ছি।
চা বিস্কুট আসতে বিস্কুটের প্লেট সরিয়ে দিয়ে শুধু চায়ের পেয়ালাই টেনে নিলেন। প্রথম চুমুকের পরেই খুশির মন্তব্য, খাসা চা–আমার লুকিয়ে চা খাবার একটা জায়গা হল।