মাস দুই ভাইয়ের মধ্যেই মনোহরের রাধা-নেশা কমে এসেছে। মদের নেশায় মত্ত হয়ে ঘরে ফেরে। তখন বাদশাই মেজাজ। অকথ্য গালাগাল করে, কথায় কথায় মারতে আসে, বিয়ে না করেও ওর থেকে কত সুন্দরী মেয়ে ভোগে এসেছে বড়াই করে বলে। মদ গিলতে গিলতে মুখ দিয়ে ফেনা উঠতে থাকে, সব কথাই জড়িয়ে যায়, রাতে ঘরে ঢোকার সামর্থ্য থাকে না। দাওয়ায় যে চটাই বিছিয়ে বসে মদ গেলে, তার ওপরেই ঢলে পড়ে। সকালের রোদে গা পুড়তে থাকলে তবে ঘুম ভাঙে। তারপরেও গুম হয়ে বসে থাকে খানিকক্ষণ, তারপর চান-টান করে খেয়ে বা না খেয়ে সেই যে বেরোয়, ফেরে রাত দশট। এগারোটায়। ঘরে ফিরে আবার দেদার মদ গেলে। কবে-কবে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এ নেশা চলে সেটা রাখা মুখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারে। বাড়িতে মদ গেলার ব্যাপারে আপত্তি করতে সে শাসিয়েছে, ফের একথা বললে ইয়ারবকশীদের নিয়ে এখানে মদের আসর বসাবে। তাদের কেউ কেউ দিনের বেলাতেও মাঝে সাঝে দাদার অর্থাৎ মনোহরের খোঁজ নিতে আসে। দরকার পড়লে তো আসেই। তাদের কুৎসিত সুব্ধ চোখ রাখার গায়ের মাংস ধুর। নিতে চায়। রাখার রাগ আর ঘেয়া মনোহর অনায়াসে বুঝতে পারে। চলে গেলে হি-হি করে হাসে। বলে বেশি দেমাক দেখাসনি, ওদের লেলিয়ে দিলে তোকে ছিঁড়ে খাবে। রাধা ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছে। কারণ, মজা টের পাওয়ার ব্যাপারে মা ওকে অনেক দূর টেনে নিয়ে যাবে এটা সে বুঝতে পারছে। মন বলছে, তো সবে শুরু।
কিন্তু এরপর যে অশান্তির শুরু রাধা সেটা সহজে বরদাস্ত করতে পারল না। একদিন দেখা করতে গেল পিছনের চালাঘরটা মনোহর লোক লাগিয়ে পরিষ্কার করাচ্ছে। কি হবে জিগ্যেস করতে গম্ভীর মুখে জবাব দিয়েছে, দরকার আছে।
দরকারটা দুদিনের মধ্যেই বোঝা গেছে। এরপর দু’চাকা লাগানো একটা ঠেলাও এসেছে ওই ঘরে। সন্ধ্যায় এক-একদিন লোক এসে ঠেলাটা নিয়ে যায়, আর রাতের অন্ধকারে ওতে বোঝাই করে কি সব আসে। চালের বস্তা হলে রাধা তক্ষুনি বুঝতে পারে। কিন্তু ঠেলা নিয়ে বোঝাই ছোট বড় টিনের কৌটো আসে রাবারের থলে বোবাই হয়ে কিসব আসে, আবার এক-আধ দিনের মধ্যে রাতের অন্ধকারে পাচার হয়ে যায়।
সেই দুপুরে মনোহর খেতে বসেছে। তার আধ-হাতের মধ্যে রাধা গালে হাত দিয়ে উপুড় হয়ে বসে। দিনের বেলাতেই মদ গিলেছে। ভক ভক গন্ধ আসছে। রাধা জিগ্যেস করল, তোমার নিজের দুটো ঘর আর অত জায়গ, খালি থাকতে পিছনের চালা ঘরে কি এনে রাখছ?
মনোহর থমকে তাকালো। কঠিন গলায় জবাব দিল, তোর জানার দরকার নেই।
ঠাণ্ডা গলায় রাধা বলল, আমার ঘরে রাখতি হলে আমার জানার দরকার আছে।
খাওয়া থামিয়ে দিয়ে চেয়ে রইলো একটু। পরের মুহূর্তে রাখা বসা থেকে তিন হাত দূরে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। চোখে অন্ধকার দেখছে। গাল কান বেড়িয়ে সমস্ত শক্তি দিয়েই চড়টা মেরেছে। আস্তে আস্তে উঠে বসতে যাতে দাঁতে দাঁত ঘষে মনোহর বলল, তোর দরকারের জবাব পেলি?
রাধা স্থির চেয়ে রইলো খানিক। গালের একদিক তপতপে লাল, ফর্সা হলে রক্ত ফেটে পড়ছে মনে হত। বলল, তোমার এত সাহস? থানার বড়বাবু আর তার বউ এখানে আসত তুমি খবর রাখো? বড়বাবুকে খবর দেব তুমি কি জিনিস রাখে, এসে দেখে যেতে।
পরের মুহূর্তে পৈশাচিক কাণ্ড। খাওয়া ফেলে উঠেছে। তারপর রাধাকে আবার মাটি নিতে হয়েছে। পাগলের মতো কিল চড় ঘুষি। সঙ্গে সঙ্গে হুংকার।ভয় দেখাচ্ছিস তুই আমাকে, বড়বাবু দেখাচ্ছিস! জোকের মুখে নুন দেবার মতো তোর বড়বাবুর বাবা আছে আমার হাতে সে খপর রাখিস? তার একটা কলমের আঁচড়ে তার চাকরি চলে যাবে–তাকে ডেকে আনবি বলে তড়পাচ্ছিস?
রাধা মুখ বুজে অমানুষিক মার সহ্য করেছে। লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে নিতেই থামল ‘ মদের নেশা ছুটে গেছে। খানিক বাদে জামা-প্যান্ট পরে বেরুনোর জন্য প্রস্তুত হল। রাধা মেঝেতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে। বার কয়েক আড়চোখে তাকে দেখে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
খুব কষ্ট হলেও রাধা জংলি কালীর পুজোয় এসেছে। এক-দৃষ্টিতে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে। মুখে কিছু বলছে না, মনে বলছে। মজা টের পাওয়াচ্ছিস, না? আমি তোরই মেয়ে ঠিক আছে।
পুজো শেষ হবার আগেই, মানে মা-কে মন ভরে ডাকা শেষ হবার আগে বিলাসীর সঙ্গে আর একজনের গলা পেল। না, রাধার মন আর স্থির হবে না। উঠে পড়ল। ঘরের আড়ালে গিয়ে পুজোর বেশবাস বদলে বেরিয়ে এলো।
মনোহর টর্চ হাতে পাশে পাশে চলেছে। মাঝে মাঝে গলা খাঁকারি দিচ্ছে। বলল, আন্ধারে কিছুতে একটা টর্চ হাতে না নিয়ে বেরুবি না, তোর বড় গো।
রাধা নির্বাক।
একটু বাদে আবার আপোসের গলা।-সকালেই মদের ওপর তুই দিলি তাতিয়ে–বিচ্ছিরি ব্যাপারটা হয়ে গেল, জানিস তো মদ খেলে আমার মাথার ঠিক থাকে না।
রাধা পথ ভাঙছে। মুখ তুলে তাকাচ্ছেও না।
হাসির চেষ্টা একটু ইয়ে, লক্ষ্মীকান্তপুরে ছিনাথদার ওখানে গেছলাম, তোর গায়ে হাত তুলেছি এনে রাগের চোটে আমার হাত ভেঙে দিতে আসে আর কি। আরে বাপ! তার এমন রাগ শিগগীর দেখিনি।–তোকে একদিন দেখতি আসবে বলেছে।
রাধার মুখে রা নেই।
ঘরে পৌঁছুলল। মনোহর এর আপোসের শেষ তাসটা ছাড়ল। আচ্ছা, তোর অপছন্দের জিনিস আর ওই চালাঘরে থাকবে না। কেবল চাল ডাল থাকলে তো আপত্তি নেই।