মোসায়েব হৈ-হৈ করে উঠল, এমন ভাগ্যি থেকে বঞ্চিত করবেন না–আপনি নিজে পরিয়ে দিন–নিজে পরিয়ে দিন।
দ্যাখো ছোঁড়াদের কাণ্ড! শ্রীনাথ হাসিমুখে হার নিয়ে এগিয়ে এলো। রাধা মাথা নোয়াতে নিজের হাতেই হার পরালো। সকলে হাততালি দিয়ে উঠল। মনোহর চেঁচিয়ে বউকে বলল, লুটিয়ে পেন্নাম কর, তোর সামনে কে দাঁড়িয়ে জানিস না!
ওই হার, সেই সঙ্গে হাতের স্পর্শ মুহূর্তের মধ্যে জল-বিছুটির মতো চিড়বিড় করে উঠল। রাধা সোজা তাকালো। তারপর দু’হাত জোড় করে মাথা নুইয়ে প্রণাম সারল। মনোহর জোরেই ধমকে উঠল, এটা কি রকম গড় করা হল–তোকে কি বললাম।
রাধার ঠাণ্ডা দু’চোখ মনোহরের দিকে ফিরল। সঙ্গে সঙ্গে শ্রীনাথ পোদ্দারও ওকেই খেঁকিয়ে উঠল, দ্যাখ মনা, তুই একটা গাধা, আজকের দিনে বউয়ের মর্যাদাখানা কি এ ধারণাটুকুও নেই! ধমক খেয়ে রাধা আস্তে আস্তে তার পায়ের দিকে হাত বাড়িয়েছিল, শ্রীনাথ বুকে সেই হাতটা ধরে ফেলে বলল, থাক, ওইটুকুতেই যথেষ্ট হয়েছে। হাতটা হাতে ধরাই থাকল, চাউনি বুকের দিকে সামান্য নেমে আবার মুখের ওপর স্থির হয়ে উঠল। রাধা চেয়ে আছে, চোখে চোখ। ছদ্ম আক্ষেপের সুরে এনাথ বলল, তিন ডাকাতের হাত থেকে বেরিয়ে এবারে আরো একটা বড় ডাকাতের হাতে পড়লি রে–।
হাসির হুল্লোড়। এমন রসিকতার কথা আর যেন হয় না। এই লোকের হাতের মধ্যে রাধার হাতটা জ্বলছে, হারের স্পর্শে গলায় ছ্যাকা লাগছে। কথাগুলো গলানো সিসের মতো কানে ঢুকেছে। –ভিতর থেকে ডাক শুনেছিল, ভুল হল, মজা টের পাবি। এই মূহুর্তে মনে হল, এই একজনও ওর জীবনে বিপদের মানুষ। এ সংকেত যেন তার চোখে মুখে লেখা।
রাত্রি। এটা রাধার দ্বিতীয় বাসর। প্রথম বাসরে হারাণ মণ্ডল তার যৌবনের আঙিনায় ভিখিরির মতো এসে গড়িয়েছিল। দ্বিতীয় বাসরের এই একজন ভোগের সদর্প উল্লাসে অধিকার বিস্তার করেছে। এই ভোগ প্রায় হিংস্র, প্রায় নিষ্ঠুর। না, রাধা দোসর হতে পারেনি।
পরদিনই রাধা নিজের ঘরে চলে এসেছে। এরকমই কথা ছিল। নিজের বাড়িতে মনোহর দিনে তার ব্যবসা আর লোকজন নিয়ে থাকবে, রাতের বাস এখানে। তার ব্যবসা বা তার লোকজন সম্পর্কে রাধার কোন ধারণা নেই। মাসখানেকের মধ্যে ধারণা করা সুযোগও হয়নি। কিন্তু সন্ধ্যায় বা রাতে এলে মদের গন্ধ নাকে এসেছে তৃতীয় দিনে সেটা প্রথম পেয়েছে। জিগ্যেস করেছে, তুমি কিছু খেয়েটেয়ে এসেছ নাকি?
মনোহর প্রথমে অবাক একটু। পরে বুঝেও ঢাকতে চেষ্টা করেনি। বলেছে, তোর খাতিরে মদ তো খেয়েছি সেই দুকুরে, তা-ও গন্ধ পাচ্ছিস? তারপরেই হ্যাঁ-হ্যাঁ হাসি, রাতে মদ খেলে তোকে সেভাবে পেতে পারি না, অপেত্যঙ্গ ছাড়াছাড়া লাগে, এ জন্যেই দিনে খাচ্ছি, তা কি হয়েছে, তোর কপালী বাবা মওকা পেলে তো দিনেও চালায়, রাত্তিরেও চালায়।
বাবা এখন রাধার কপালী বাবা হয়েছে। আর দিনে মদ গেলার কারণ, রাতে খেলে ভোগে ঘাটতি পড়ে। একটা মাস ধরে এই ভোগের হিংস্র নিষ্ঠুর উল্লাস দেখে যাচ্ছে রাধা। একদিন কেবল বলেছিল, তুমি আমাকে বে-করা বউ ভাবব না আর কেউ ভাবব–এ কেমনধারা লম্পটের মতো আনন্দ করা তোমার?
জবাবে দাঁত বার করে হেসেছে, যন্ত্রণা স্বীকারই করেছে, মরদ কেমন টের পাচ্ছে। পরে বলেছে, অবাক করলি যে, লম্পট পছন্দ নয় তোর। আরো অর্থপূর্ণ আরো কুৎসিত হাসি। তারপর চাউনি একটু একটু করে ক্রুর হয়ে উঠেছে। বলেছে, শয়ে শয়ে লাল পিঁপড়ে দিয়ে আমার গায়ের মাংস কুরে খাইয়েছিস, সে-যা আমি ভুলে গেছি ভেবেছিস?
তপতপে মুখ করে রাধা বলেছে, সে-যন্তয়াও কিছু নয় বলে তো ঘরে বিষ মজুত রেখেছিলে!
আবার হি হি হাসি।–বিষ। তোর মতো মেয়ের জন্যি?–তা তোকে দেখাবার জন্যি ঘরে একটা শিশিতে গ্লুকোজের গুড় কিছু রেখেছিলাম বটে, কিন্তু দেখানোরও দরকার হলনি, শুনেই ঢলে পড়লি!
ঘৃণায় রাগে রাধা স্তব্ধ।–ভুলের বহর তো বুঝতেই পারছে, এরপর কি মজা টের পেতে বাকি?
ওর দিকে চেয়ে উৎকট আনন্দে মনোহর বুক ফুলিয়ে বলল, নিজের বোনাইয়ের সঙ্গে বে তে বসলি যখন, নিতাইয়ের দোকানে বসে বুক ঠুকে পিতিজ্ঞে করেছিলাম তোকে আমি কজায় আনব, না যদি পারি আমাকে যেন বেজন্মার ছেলে বলে-হারাণ মণ্ডল ভালোয় ভালোয় নিজে না মরলে ডাকাত কাকে বলে দেখতে পেতিস– কোথায় তোক নিয়ে উধাও হতাম কাক-পক্ষী টের পেত না। এই এক বছর ধরে আমি কোন্ জোরের মানুষ তোর ধারণা নেই–আমার মুরুব্বিকে দেখেছিস কিন্তু জানিস না।
রাধা সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছে এক বছর ধরে কে তার মুরুব্বি। লক্ষ্মীকান্তপুরের শ্রীনাথ পোদ্দার।
কপালী বাবা হিমালয়ে বেরিয়ে পড়েছে। মনে মনে অনেক বছর ধরেই প্রস্তুত হচ্ছিলেন, এবারে চট করেই সুযোগ হয়ে গেল। মনোহর পাইক রাধার মারফৎ দরাজ হাতেই তাকে টাকা দিয়েছে। রাধার মুখ দেখে বাবার কিছু খটকা লেগে থাকবে, মনোহরের অগোচরে অনেকবারই ওকে জিগ্যেস করেছেন, কেমন বুঝছিস ছোঁড়াটাকে–বল না?
কঠিন গলায় রাধা একই জবাব দিয়েছে, তুমি এ নিয়ে মাথা ঘামিও না বাবা, তুমিও এ বিয়ে চেয়েছিলে বলে তোমাকে একটুও দুষব না-বোঝাপড়া যদি কিছু হয় তো মায়ের সঙ্গেই হবে।
কপালী বাবা কত মাস বাদে ফিরবেন সেটা তিনিও জানেন না। জংলি কালীর পুজোর ভার মনোহরের সামনেই তিনি রাধাকে দিয়ে গেছেন। রাতের এই সময়টুকুই কেবল রাধার শান্তি। সন্ধ্যার মধ্যে আসে, কিন্তু ঘণ্টা দুই আড়াইয়ের মধ্যে ফিরতেই হয়। এরই মধ্যে শাসানো হয়ে গেছে, আমার দরকারে সময় না পেলে তোর পুজোটুজো বন্ধ করে দেব। রাধা মনে মনে জবাব দিয়েছে, তোমার মতো তিন পাষণ্ড এলেও ক্ষমতায কুলোবে না, কিন্তু ঝগড়া এড়াবার জন্য জবাব দেয়নি। বিয়ের পর থেকে বিলাসীর আবার ঠাঁই বদল হয়েছে, এখানকার ডেরার দাওয়ায় পড়ে থাকে। ফল-ফুল সরঞ্জাম সে-ই গুছিয়ে রাখে রাধার একপ্রস্থ য় জামা-কাপড় এখন মায়ের ঘরেই দড়িতে ঝোলানো থাকে। পরা-কাপড় বদলে রাখা পুজোয় বসে। পুজোয় বসা মানে আকুল হয়ে মা-কে ডাকা।