সরু রাস্তার এদিকে রাধা, ওদিকে মনোহর পাইক। অন্ধকারে কেউ কারো ভালো করে মুখ দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু দুজনেই দুজনার দিকে চেয়ে আছে।
রাধাই প্রথম ঝাঝালো গলায় কথা বলল, ভেতরে আসার ইচ্ছে না ঘরে ফেরার?
সাইকেল নিয়ে মনোহর আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো। গম্ভীর গলায় বলল, আমি কেবল শেষবারের মতো দু’চারটে কথা বলার মতো সময় চাইছি।
রাধাও তেমনি গম্ভীর।–দুটো কি চারটে কি তার বেশি আগে হিসেব করি নাও, আমি গুনব।
মনোহর চুপ করে চেয়ে আছে।
-আচ্ছা বলে ফ্যালো।
ইখেনে দাঁড়িয়ে?
রাধা বলল, ও-মাঝ রাতে ঘরে ঢুকি বলার মতো কথা? আচ্ছা তোমার কথা আমি বুঝি নিছি, আমার জবাব কাল বাবাব থেকে শুনি নিও
খুব ঠাণ্ডা মুখ আর ঠাণ্ডা গলা মনোহরের। যদিও রাধার কথাবার্তার সুর আজ অন্যরকম লাগছে, কিন্তু এটুকু বিশ্লেষণ করার মতো মন নয়–শোন রাধা, আজই হাঁ-না শেষ কথা বলে দে, কাল বা আর কোনোদিনই হয়তো আর আমার মুখ দেখবি না!
উঠোনে পা দিতে গিয়েও রাখা ঘুরে দাঁড়ালো। আবছা অন্ধকার ফুড়ে মুখখানা ভালো করে দেখতে চেষ্টা করল।-কেন? গাঁও ছাড়ি বিবাগী হয়ে যাবে?
মনোহর তেমনি ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিল, গাও ছেড়ে না।… একদিন তুই আমাকে শয়ে শয়ে পিঁপড়ে দিয়ে খাইয়েছিলি, এমন যার তুলনায় ওটা কিছু না–তা যন্তন্ন শেষ করতে গাও ছাড়ি না, আমি দেহ ছাড়ার শপথ নিছি, তার ব্যবস্থা মজুত আছে, তুই তোর শেষ কথা বলি দে।
রাধার বুকের ভিতরটা ভয়ানক ধড়ফড় করে উঠলো। মনে হল দশ বছর আগে শয়ে শয়ে লাল পিঁপড়েগুলো এক সঙ্গে ওর দেহেই কামড় বসালো। পরের মুহূর্তে ভয়ংকর রাগ হয়ে গেল। কাল কি শুনতে বাবার কাছে যেতে বলেছে এই গোঁয়ার তা-ও বোঝেনি। অস্ফুট স্বরে বলল, ভিতরে আসি দাঁড়া–
নিজে আগে হন হন করে চলে এলো। আধা-আধি দরজা আগলে বিলাসী দাওয়ায় শুয়ে আছে, তার মাথার কাছে লণ্ঠন জ্বলছে। নাক ডাকিয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে সে। দেখে নিয়ে রাধা তেমনি দ্রুত ফিরল। মনোহর সাইকেলটা বাইরে ঠেস দিয়ে রেখে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে।
রাধা তার আধ হাতের মধ্যে এগিয়ে এলো। ফিসফিস গলায় রাগ ঝাড়ল, বীর মরদের মুখখানা ভালো করি দেখতে পেলি হত। খপ করে দু’হাতে তার চুলের মুঠো ধরে মাথাটা নিজের মুখের সামনে টেনে নামালো। একটা চুমু খেয়েই ধাক্কা মেরে ঠেলে সরালো। –শেষ কথা হল? এখন ঘরে গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাও গে যাও।
৬. ভুল হল, খুব ভুল হল
এবারও কপালী বাবাই বিয়ে দেবেন। জংলি কালীকে প্রণাম করার জন্য এগিয়ে যেতেই রাধার ভিতর থেকে কেউ বলে উঠল, ভুল হল, খুব ভুল হল। মজাখানা টের পাবি।
রাধার দুপা মাটির সঙ্গে আটকে গেল। মুখে আর দু’চোখে রক্ত উঠতে লাগল। কালীর মুখের দিকে চেয়ে আছে। দু’চোখ জ্বলজ্বল করছে রাধার। বিড়বিড় করে বলল, রাক্ষুসী! আগে বললি না কেন? ভুল পথে নিজে টেনে নিয়ে গিয়ে কত আর মজা দেখাবি? শেষে তো আমাকে বাঁচানোর দায়ে নিজে এক বুড়ীকে খেয়েছিস! সাধ্য থাকে তো এবার আমাকে খেয়ে মজা দেখার সাধ মেটা।
হঠাৎ ওর চোখ মুখের এই পরিবর্তন দেখে কপালী বাবা অবাক। মনোহরও। কপালী বা উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, হঠাৎ হল কি রে তোর, বিড়বিড় করে কি বলছিস?
আরক্ত চোখে রাধা ঘুরে তার দিকে তাকালো। তারপর মনোহরের দিকে। শেষে আস্তে আস্তে আবার কালীর দিকেই ফিল। হাঁটু মুড়ে বসে মাটিতে মাথা রেখে অনেকক্ষণ ধরে প্রণাম করল। মনে মনে কেবল এক কথাই বার বার বলে গেল। তোর দায় তোর দায় তোর দায়। তুই সব করাচ্ছিস, সব করাচ্ছিস। তোর পরীক্ষায় আমি ভয় পাই না, ভয় দেখাস না, ভয় দেখায় না। রাখলে তুই রাখবি, খেলে তুই খাবি, লেখা কত মজা দেখাবি, তোর পা যেন না ছাড়ি না ছাড়ি, ছাড়লে তোর হার তোর হার তোর হার!
বিয়েটা নিঃশব্দে হয়ে গেল। কিন্তু দুদিন বাদে বউ ভাতের ঘটা দেখালো মনোহর পাইক। তার ঘরের সামনে মশু সামিয়ানা খাঁটিয়ে উৎসব। এ উৎসবে রাধাকে যারা স্নেহ করে, ভালবাসে তাদের কেউ নেই। সকলেই মনোহরের ইয়ারবকশী আর তার ব্যবসার খাতিরের লোক। এদের মধ্যে নিতাই স্যাকরাও আছে। রাধার প্রথম বিয়ের পর থেকেই মনোহরের তার সঙ্গে গলায় গলায় ভাব।
-এই উৎসবে আরো একজন অতিথির পদার্পণ ঘটতে উপস্থিত সকলে মহাব্যস্ত। মনোহর আর তার সাঙ্গপাঙ্গারা তাকে কোথা বসাবে, কত ভাবে আপ্যায়ন করবে ভেবে পায় না। রাধা সহজে ভোলে না, দেখামাত্র চিনল। এদিকের সমস্ত অঞ্চলের নামজাদ। জোতদার শ্রীনাথ পোন্দার–লক্ষ্মীকান্তপুরে যার নিবাস। আজ আর হাঁটুর নিচে কাপড় তোলা নয়, খুব সাজগোজ করে এসেছে। হাসি হাসি মুখে সামনে এসে দাঁড়ালো, বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখল, তার পর মন্তব্য করল, বহর পাঁচ ছয় আগেও একবার দেখেছিলাম, এখন তার থেকেও পাঁচছ’গুণ খাসা দেখতে হয়েছে, তোর বিবেচনা আছে দেখছি রে মনা।
মনা অর্থাৎ মনোহর তার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে ঘটা করে প্রণাম কৈল একটা। আহাদে গদগদ, আপনি হলেন গে আমার গার্জেন, আপনার প্রশংসার লাখো টাকা দাম মানি।
শ্ৰীনাথ পোদ্দার হাতের গয়নার বাক্স খুলে সরু একটা সোনার চেন হার বার করল। মনোহরকে বলল, নে তুই পরিয়ে দে।
জোরালো আপত্তি তুলে মনোহর বলল, বাঃ, আমি কেন, আপনার আশীৰ্বাদ আপনি নিজে হাতে পরিয়ে দিন ছিনাথদা, এমন ভাগ্যি আর কি আমাদের হবে!