এ-রকম বার দুই তিন হবার পর রাধা ঠিক করেছে যা বলার কপালী বাবাকে দিয়েই বলবে। কিন্তু পরদিন সন্ধ্যার পর ওই মূর্তি সোজা কপালী বাবার ডেরায় এসে হাজির। হাতে একটা টর্চ। সাইকেলটা দাওয়ায় ঠেস দিয়ে রেখে উঠে এলো। কপালী বাবাকে বেশির ভাগ লোক ভক্তি যত না করে ভয় হয়তো তার থেকে বেশি করে। রক্ত চক্ষু মেলে রাধা এই একজনের বুকের পাটা দেখল। টর্চটা কপালী বাবার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এটা ওকে দিয়ে দিও বাবা, এই গরমে যা সাপের উপদ্রব, অন্ধকারে পথ চলা ঠিক নয়।
সাপের উপদ্রব নতুন কিছু নয়, আর রাধা ছেলেবেলা থেকেই রাতে পায়ে হেঁটে চলা-ফেরা করছে। সাহস দেখে অবাক। আর বাবাও তেমনি, টর্চটা নেবে কি নেবে না ভেবে পাচ্ছেন না। রাধা হিসহিস করে বলে উঠল, আমাকে সাপে কাটুক বাঘে খাক তোমার তাতে কি?
জবাব না দিয়ে টর্চটা বাবার সামনে রেখে প্রস্থান করল। না রাধা ও-টর্চ ছোঁয়ও নি।
কিন্তু সাত আট মাস ধরে এরকম নীরব উপদ্রব বেড়েই চলল। রাধার ঘরের সামনের রাস্তা দিয়ে সাইকেলে কম করে বিশ ত্রিশবার যাতায়াত করে। আবার এক-একদিন সকালে ঘর ছেড়ে দাওয়ায় দাঁড়িয়েই রাধা দেখে সাইকেলে ঠেসে দিয়ে ওই মূর্তি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হয়, রাধা দুচোখে ওকে ভস্ম করতে চায়। মনোহর পাইক নির্লিপ্ত মুখে সাইকেলে উঠে চলে যায়। একদিন গিয়ে দেখে সে আগে থাকতে কপালী বাবার ডেরায় জংলি কালীর সামনে বসে আছে। একদিন দেখামাত্র রাধা কপালী বাবার ওপরেই রাগে ফেটে পড়ল।-বলি এত লাই দিচ্ছ কেন, এখানে একটু নাম করতি আসি তা-ও বন্ধ করতি চাও?
ওর রাগ দেখেও কপালী বাবা হাসছেন। মনোহরের দিকে তাকালেন।–বললাম, ওর আসার সময় হয়েছে, পালা–এখন দোষটা পড়ল আমার ঘাড়ে।
মনোহর একটি কথাও বলল না। উঠে চলে গেল। রাধা সরোষে তাকে যেতে দেখল তারপর বাবার দিকে ফিরল। ওকে এরকম করে আসকরা দিচ্ছ কেন, তোমারও কি ইচ্ছে একটা বছর না যেতে আমি ওকে বিয়ে করে বসি।
একটু চেয়ে থেকে কপালী বাবা বললেন, বছর যেতে আর দেড় মাসও বাকি নেই।–তার পরে বিয়ে করতে রাজি আছিস?
রাধা তাজ্জব হয়ে চেয়ে রইলো খানিক। তারপর বলে উঠল, তোমাকে কি খুব বেশি বোতলের ওপর রেখেছে ও?
–তা রেখেছে।…আবার আমার একবার হিমালয়ে ঘুরে আসার সাধ দেখে খরচ যা লাগে তাও দেবে বলেছে।
রাধা কি নিজের কান দুটোকে বিশ্বাস করবে? বাবার হিমালয়ে ঘোরার অনেক দিনের সাধ জানে। আগে অনেক সময়ই রাধাকে বলেছেন, মা যদি যোগাযোগ করে দ্যান, এখানে এসে মায়ের পুজোটা তুই রোজ করে যেতে পারবি না? মন্ত্র-টন্ত্রের দরকার নেই, তোর মতো পুজো আর কেউ করতে পারবে না।
বাবা আবারও গম্ভীর তেমনি আমার কথা ছেড়ে দে, ওর মদ না খেলেও আমার দিন চলে যাবে, আর মা না চাইলে হিমালয়ও হবে না–ছোঁড়াটা আমাকে পাগল করে ছাড়ছে তা-ও না। আমার কথা তোর ভাবার দরকার নেই, কিন্তু তুই কি করবি সেটা খুব ভালো করে চিন্তা কর। আমার মাঝে মাঝে খটকা লাগে, মনোহর সেই ছেলেবেলা থেকে যে ভাবে তোকে চেয়ে আছে, বয়েস তিরিশ পার হতে চলল তবু বিয়ে করল না–ওর জন্যেই মা অমন হুট করে হারাণকে টেনে নিল কিনা।ও বলে হারাণকে তুই কেবল জেদ করে বিয়ে করেছিলি। সে যাক, তুই তোর মনের দিকে তাকা, মনটাকে খুব ভালো করে দেখে আর বুঝে নে, এভাবেই জীবনটাকে চালিয়ে দিবি এ-সংকল্পের যদি নড়চড় না হয় তাহলে মনোহরকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে আমার দুদিনও লাগবে না।
সেই রাতে নাম-গান করতে গিয়েও রাধা বিমনা হয়ে পড়ছিল। ঘরে ফিরেও অনেক রাত পর্যন্ত ছটফট করেছে। কপালী বাবা যেন ওর অগোচরে একটা পর্দা সামনে থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। নিজের মন দেখতে পাচ্ছে রাধা-যে একজন এসেছিল, সে তার জীবন বা যৌবনের দোসর হতে পারেনি। পরিপূর্ণ যৌবনের নারী-সত্তা যে এমন উপোসী, তার হদিস আর কি কখনো পেয়েছে। বাবা তার এ কি সর্বনাশ করে বসল? পরেই মনে হল, বাবা ওর নিজের মন দেখতে আর বুঝতে বলেছে শুধু। ওর ভিতরে রস-কষ নেই, এমনতো নয়, এই উপোসী সত্তাকে চোখ ঠেরে আর কতদিন দাবিয়ে রাখা যেত? এই প্রথম টের পেল তার ভিতরের ওই উপোসী রমণী সত্তা খুব স্থির হয়ে বসে নেই।
পরের রাতে রাধা জয়নগরের রুমা সেনের বাড়ি থেকে গান গেয়ে ফিরছিল। রাধাভাবে রাধা আবিষ্ট, রুমা সেন চোখের জলে ভেসেছেন।
মানা করি নাই রংগিনী আর যমুনায় যাইও না,
কালো রূপ লাগিলে অঙ্গে হেমাংগী আর রবে না।
রাধা সাইকেল রিকশয় ফিরছে। রাত দশটার কাছাকাছি। তাকে পৌঁছে দেবার জন্য রুমা সেনের ভাগ্নে অজয় গুপ্ত সাইকেলে পাশে পাশে আসছে। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি খেয়ে একবার ঘাড় ফেরাতে রাধার মনে হল অজয় গুপ্তর দেড় দু’হাত তফাতে আরো একজন সাইকেল চালিয়ে আসছে। ভালো করে তাকালো। তাই।
আত্মস্থ হতে কয়েক সেকেণ্ড সময় লাগল। তারপর বেশ সহজ গলায় রাধা অজয় গুপ্তকে বলল, তোমাকে আর আসতে হবে না বাবু, তোমার পাশে যে আসছে সেই পৌঁছে দেবে।
কথাগুলো মনোহর পাইকেরও কানে গেল। অজয় গুপ্ত ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল কে আসছে, তারপর সাইকেল ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল।
ঘরের সামনে এসে রাধা সাইকেল রিকশ থেকে নামল। সাইকেল থেকে মনোহরও। রিকশ ভাড়া রুমা সেন আগেই দিয়ে রেখেছিলেন, সে রিকশ নিয়ে চলে গেল।