ঠোঁট উল্টে ভিতরে চলে এলাম। এ ধরনের কৌতূহল কারোরই ভালো লাগার কথা নয়। আত্মীয় পরিজন কেউ হতে পারে, ছেলে বা মেয়ের বাড়ির কেউ হতে পারে। এমন কি সদ্য নিযুক্ত কোনো রাঁধুনী-টাঁধুনি হতে পারে যে বাড়ি চেনে না বলে গাড়ি করে নিয়ে আসা হল।
আধ-ঘণ্টাখানেক বাদে মনে হল ওই দোতলার ফ্ল্যাট থেকে গানের গলা কানে আসছে। পায়ে পায়ে কোণের ঘরের জানলায় এসে দাঁড়ালাম। সামনের ঘর নয়। রাস্তার দিকের ঘর থেকেই গান ভেসে আসছে। মেয়ের গলা যখন, যে খানিক আগে এলো সে ছাড়া আর কে হতে পারে। বাজনা-টাজনা নেই, খালি গলার গান। গানের কথা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে না, তবে গলা চড়লে ভক্তিমূলকই মনে হচ্ছে। দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনার মতো খুব উঁচুদরেরও মনে হল না আমার। তবে গলাটি বেশ নিটোল মিষ্টি। ভাবের আবেগও একটু আধটু আঁচ করা যাচ্ছিল।
ঠায় দাঁড়িয়ে শুনিনি, খান তিন-চার গান হল বোধহয়। মাঝে মাঝে সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়াচ্ছিলাম। ভদ্রলোকের গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, গ্যারাজ করা হয়নি। গান শেষ হবার পনেরো বিশ মিনিট বাদে মেয়েটিকে আবার গাড়িতে এসে উঠতে দেখলাম। ভদ্রলোক তখন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন।
এবারে আমার কৌতূহল একেবারে হয়নি বললে সত্যের অপলাপ হবে। কিন্তু সেটা অস্বাস্থ্যকর বা অশোভন কিছু নয়। কৌতূহল একটু ভদ্রলোকটিকে নিয়েই। ওই ফ্ল্যাটের আগের বাসিন্দাটি বলে গেছলেন, যিনি আসছেন তিনি রাশভারী মানুষ, জাঁদরেল পুলিশ অফিসার ছিলেন, নিরিবিলি-নির্ঝঞ্ঝাটে থাকতে চান বলেই দূর সম্পর্কের বড় সংসারের আত্মীয়টির নিচের তলাতেও ঠাঁই হয়নি। সবই মিলছে।–সকালে গরম জলের সঙ্গে ব্রাণ্ডি চলে, পাড়ার কেউ সৌজন্যে আলাপ করতে এলে দু’কথায় তাকে বিদায় করে দেওয়া হয়–আবার রাতে এ-বাড়িতে যতক্ষণ ঠাকুরের শয়ন আরতি চলে ততক্ষণ ভদ্রলোকের প্রণামের জোড়হাত কপাল থেকে নেমে আসে না, একলা বাড়িতে এই বয়সের একটা মেয়ে এসে তাঁকে গান (যদিও ভক্তিমূলক) শুনিয়ে যায়, তাকে গাড়ি করে নিয়ে আসা হয়, পৌঁছে দেওয়া হয়–এরকম মানুষ সম্পর্কে লেখকের কৌতূহল তার পেশার অঙ্গ।
আরো দিন তিন-চার বাদে অন্তরঙ্গ আলাপের অভিনব সূত্রপাত ঘটল। দোতলার কোণের ঘরে বসে আমি লিখি। সামনের দরজার পর্দা তখন তোলাই থাকে। কারণ লিখতে লিখতে মুখ তুললে আকাশের অনেকটা দেখা যায়। সেটা ভালো লাগে। আবার ওদিকে ফালি বারান্দার এ-মাথায় কেউ এসে দাঁড়ালে এ-ঘর তখন বে-আবরু। ঘরের সবটাই দেখা যায়। কিন্তু সে-রকম ইচ্ছে না থাকলে কেউ আর এখানে এসে দাঁড়াবে কেন? তাই আমার লেখার ব্যাঘাত বড় একটা ঘটে না। সেদিন নিবিষ্ট মনেই লিখছিলাম। হঠাৎ মুখ তুলে দেখি ও-দিকের রাশভারি পুলিশ অফিসারটি তাঁর বারান্দার কোণ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এই ঘরের দিকেই চেয়ে আছেন। চোখাচোখি হতে সামান্য অপ্রস্তুত। হাসি-হাসি মুখ করে ডান হাত তুলে সামনের দিকে একটু নাড়লেন, অর্থাৎ, ডিসটার্ব করে ফেললাম, বসুন বসুন, উঠতে হবে না। তাড়াতাড়ি সরে গেলেন।
কলম রেখে আমি উঠতেই যাচ্ছিলাম বটে।
সেই সন্ধ্যার খানিক আগে আমি বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই উনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন। মনে হল আমার দেখা পাওয়ার অপেক্ষাতেই ছিলেন। আমিও এগোলাম।
-ফ্রি আছেন? একটু আসব?
ব্যস্ত হয়ে বললাম, আসুন আসুন
–আপনি হার্ট পেশেন্ট শুনেছি, আপনি নিচে না নেমে আমি ওপরে উঠলে অসুবিধে হবে না তো?
-কিছু না, আসুন।
আমি সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়ালাম। প্রায় এক মাস বাদে এই আলাপের আগ্রহ, আবার আমি হার্ট পেশেন্ট এও শুনেছেন।
নিচে পায়ের শব্দ শুনে আমি দু-ধাপ নেমে এসে সাদর অভ্যর্থনা জানালাম, আসুন–
বেশ বলিষ্ঠ পদক্ষেপে উঠে আসতে আসতে বললেন, একটু বাদেই হয়ত লিখতে বসবেন, এসে ডিসটার্ব করলাম না তো?
হেসে বললাম, খুব চাপ না থাকলে রাতে আমি লিখি না– কিন্তু আমি লিখি, আমি হার্ট পেশেন্ট, এসব খবর আপনাকে কানে কে দিলে?
আমার লেখার ঘরে তাঁকে এনে বসালাম। একটু জোরেই হেসে তিনি আমার কথার জবাব দিলেন, আরে মশাই আর বলবেন না, আপনার জন্য কাল রাতে আমার মেয়ে আর বউমার কাছে বেইজ্জত হয়ে গেছি। আমি হলাম গিয়ে চোর-ডাকাত ঠেঙানো আর মিনিস্টার সেক্রেটারি ওপরওয়ালাকে তেল-দেওয়া পুলিশ–আমার নাকের ডগায় কে গুণী লোক বাস করছেন না করছেন পরিচয় জানলেও তাঁর মর্ম বুঝব কি করে বলুন তো? গত রাতে মেয়ে হুকুম করে গেছে, তুমি কালই অবশ্য গিয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করবে, পরে আমরাও যাব।
ভদ্রলোকের মধ্যে নিজের অপরাধ স্বীকার আর স্তুতি-বচনের সহজ সরলতাটুকু ভালো লাগল। হেসে বললাম, আপনি সত্যিকারের ব্যস্ত মানুষ, আমার মতো লেখক চেনার প্রত্যাশা নিজেরও নেই– আপনার বে-ইজ্জত হবার কোনো কারণ নেই, কিন্তু আপনার মেয়ে আমার ইজ্জত প্রাপ্য থেকেও অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তাকে আর আপনার বউমাকে আমার ধন্যবাদ জানাবেন।
মুখখানা একটু গম্ভীর করে মাথা নাড়লেন।–উঁহু, এতগুলো ভালো-ভালো কথা তো আমার মনে থাকবে না।
এরপর হাসিমুখে যেটুকু সমাচার শোনালেন তার সার, এর মধ্যে সামনের দোতলার অমর গাঙ্গুলী আর তার পাশের বাড়ির একতলা দোতলার দুই ভদ্রলোক একসঙ্গে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে গেছলেন। কথায় কথায় পড়শীদের প্রসঙ্গ উঠেছে, আমার নাম পরিচয় আর হার্টের কথাও অমর গাঙ্গুলী বলেছেন। তিনি শুনে গেছেন এই পর্যন্ত, কারো সম্পর্কেই তেমন আগ্রহ ছিল না। গেল রাতে মেয়ে-জামাই আর ছেলে-ছেলের বউ এসেছিল। কথায় কথায় মেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল পাশের বাড়িতে কে থাকে। জবাবে তিনি বলেছিলেন ওমুক নামের একজন লেখক থাকে শুনেছি। শুনেই তারা যেমন অবাক তেমনি খুশি। তারপর মেয়ের ওই অনুযোগ, চোর-ডাকাত আর ওপরওয়ালা ছাড়া দুনিয়ার আর কাউকে তুমি চিনলেই না। ওদের হুকুম কালকের মধ্যে এসে যেন আলাপ করে নিজের ত্রুটি স্বীকার করে নেন।