গত পনেরো দিনের মধ্যে বড় জোর পাঁচ-সাতবার তাঁকে বারান্দায় দেখেছি। দুই-একবার হাঁটেন, রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে খানিক রাস্তা দেখেন, ভিতরে চলে যান। ইদানীং আমিও সকালে বেরুতে পারছি না। শারীরিক অসুস্থতাই বড় কারণ, তার ওপর লেখার চাপ। সকালে বিকেলে বারান্দাতেই খানিক পায়চারি করি। তখন চোখাচোখি হয়। তিনিও নিস্পৃহ, আমিও। খবরের কাগজ এলে বারান্দায় পাতা ইজিচেয়ারে বসেই অনেকক্ষণ ধরে পড়েন। তখন মুখ দেখা যায় না। দিন সাত-আট বাদে একদিনই কেবল দু-চারটে কথা হয়েছিল। সকালে তিনি তাঁর ছোট্ট বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। আমার দোতলার বারান্দা তাঁর ডবল হবে। নিজের অগোচরে আমি হয়তো একটু জোরেই হাঁটছিলাম। একবার দুই বারান্দা-প্রান্তে মুখোমুখি হতে মৃদু হেসে পরিচিত জনের মতোই বললেন, আপনি তো ভালই মর্নিংওয়াক সেরে নিচ্ছেন দেখছি–
গলা সেই প্রথম শুনলাম। বেশ ভারী পুষ্ট কণ্ঠস্বর। আমি সৌজন্যের দায়ে একটু হেসে দাঁড়িয়ে গেলাম।
–লেক তো কাছেই, লেকে যান না কেন?
সবিনয়ে জবাব দিলাম সেটাই অভ্যাস, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না তাই বাদ পড়ছে।
বললেন, আমারও সেই অবস্থা, এখানে আসার আগেই ছকে রেখেছিলাম রোজ সকালে লেকে হাঁটব, আসতে না আসতে কি-রকম একটা গলার ট্রাবল শুরু হয়ে গেল।
ব্যস আর কোনো কথা নয়, তাঁর কাগজ এলো, সেটা নিয়ে তিনি ইজিচেয়ারে বসে গেলেন।
এধরনের আলাপের মধ্যেও একটু আভিজাত্যের গন্ধ পেলাম। কোনো কারণ নেই, তবু মনে হল দু-হাত কপালে তোলার প্রাথমিক সৌজন্যও বাতিল করে তিনি যেন দুটো কথা বলে আমাকে একটু অনুগ্রহ করলেন।
এ-রকম ভাবার একটু কারণও ছিল। রাস্তার উল্টোদিকে মুখোমুখি বাড়ির সমবয়সী ভদ্রলোকটি মাঝে মাঝে গল্প করতে আসেন। নিন্দে না করেও বলা যায় বয়েস অনুযায়ী ভদ্রলোক একটু বেশি রসিক এবং প্রতুলভাষী। নাম অমর গাঙ্গুলী, কাজের সময় এসে বসলে তাঁকে বিদায় করতে বেগ পেতে হয়। দিন তিনেক আগে এসেই তিনি জিগ্যেস করেছিলেন, কি মশাই জাঁদরেল পুলিশ অফিসারের ঘর থেকে সন্ধ্যার পর বেশ হুইস্কির গন্ধটগ্ধ পাচ্ছেন তো?
-না তো–কেন?
-সে কি মশাই, সকালেই চলে আর রাতে চলে না? লেখক হয়েও আপনি এমন বে-রসিক।
তারপরেই এ উচ্ছলতার কারণ ব্যক্ত করলেন। রাস্তার কোণের দত্ত বাড়ির কন্ট্রাক্টর দত্ত সহ দুদিন আগে সকাল দশটায় কর্তব্যের খাতিরে নতুন পড়শীর সঙ্গে আলাপ পরিচয় করতে এসেছিলেন (আমরা জানি বিনা স্বার্থে এটুকু তিনি করেন না), তা আপনার নতুন নেকসট ডোর নেবার ঘোষ সাহেব (ঘোষ যে এই প্রথম শুনলাম) তখন গরম জলে ব্রাণ্ডি মিশিয়ে সিপ করছিলেন, দত্ত সাহেবকে জানালেন গলার ট্রাবলের জন্য খাচ্ছেন, আর এ-ও জানিয়ে দিলেন বেশি কথা বলা ডাক্তারের বারণ। সাদা কথায় দু-পাঁচ কথার পরেই বিদায় করলেন, বুঝতে পারছেন?
বুঝেও আমি তেমন আগ্রহ প্রকাশ করিনি বা কথা বাড়াইনি।
এই কারণেই হয়তো ঘোষ সাহেবের ও-ভাবে যেচে কথা বলার মধ্যে আমি অনুগ্রহের আভাস আবিষ্কার করেছিলাম।
কিন্তু পরের সন্ধ্যায় একটা ব্যাপার দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম। আমি সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। নিজের বারান্দায় ঘোষ সাহেবও। আমাদের ঠাকুর ঘরে নারায়ণের সন্ধ্যারতি শুরু হল। শঙ্খ কাঁসর ঘন্টা বেজে উঠল। এটা নৈমিত্তিক ব্যাপার ও-বারান্দায় ঘোষ সাহেবের মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু রাস্তার আলোয় তাঁর অবয়ব ঠিকই দেখা যাচ্ছে। দেখলাম তাঁর হাত দুটি যুক্ত হয়ে কপালে উঠল। তারপর যতক্ষণ এদিকে শয়ন আরতি চলল, (কম করে সাত আট মিনিট হবে) ততক্ষণ এই দুই হাত কপালে যুক্ত হয়েই রইলো।
অভ্যাসে হাত আমাদেরও কপালে ওঠে, সেটা পাঁচ-সাত সেকেন্ডের জন্য। এতক্ষণ ধরে এই নিবিষ্ট প্রণাম বা শরণ দেখব এ আমার কাছে কেন যেন প্রত্যাশিত ছিল না। বড় পুলিশ অফিসার ছিলেন বলেই এই প্রণাম দেখে যা প্রথমে মনে এলো সেটাকে সুস্থ চিন্তা বলা যাবে না। সে কথা থাক।
সন্ধ্যা থেকে রাত ন’টা সাড়ে ন’টা পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় আমার এই সামনের বারান্দায় বসে বা পায়চারি করে কাটে। ভক্তির ব্যাপারটা আরো দুই-একদিন লক্ষ্য করলাম। ও-সময়ে সব-দিন অবশ্য ভদ্রলোক বারান্দায় থাকেন না। সেদিন সন্ধ্যার কিছু আগে আমি রেলিং-এর সামনে দাঁড়িয়ে। ফুটপাথ ঘেঁষে ঘোষ সাহেবের অ্যামবাসাডার গাড়িটা থামলো। না-বাবু না-চাকর লোকটি চালকের আসনে। সে নেমে এসে পিছনের দরজা খুলে দিতে আটপৌরে বেশ-বাসের একটি রমণী গাড়ি থেকে নামল। খুবই সাধারণ বেশ। গায়ে কোনো গয়না নেই। মাথায় ছোট ঘোমটা। সন্ধ্যায় না হোক দিনের আলোয় বেশ টান ধরেছে। কপালে সিঁথিতে সিঁদুর আছে কি নেই ঠাওর হল না। পায়ে রাবারের চপ্পল। গাড়ি থেকে না নামলে বাড়ির কাজ-করা ভদ্রগোছের মেয়েও ভাবা যেত। যতটুকু নজরে এলো, কালোর ওপর বেশ সুশ্রী আর স্বাস্থ্যের অধিকারিণী মনে হল। লম্বা গড়ন। বয়েস বছর আঠাশ-তিরিশ হতে পারে।
দিন কুড়ির মধ্যে মেয়ে আর পুত্রবধুকে অনেক বারই দেখেছি। একে আর কোনদিন দেখিনি।
সামনে তাকিয়ে দেখি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অমর গাঙ্গুলীও ঝুঁকে আগ্রহ সহকারে লক্ষ্য করছেন। রমণীটি চোখের আড়াল হতে আমার সঙ্গে চোখাচোখি। মাথা ওপর দিকে উঁচিয়ে ইশারায় যে প্রশ্ন ছুড়লেন, তার একটাই অর্থ, কে হতে পারে?