সংস্কার কেবল দোতলার ফ্ল্যাটেরই হল। আর রং যখন হল গোটা বাড়িটাতেই রঙের পালিশ পড়বে জানা কথা।
প্রথমে একটা লরি এলো, তাতে মালপত্র খুব বেশি নয়। চকচকে বড় খাটের খোলা পার্টস, জাজিম তোষক বালিশ ইত্যাদি ফ্রিজ, সুন্দর সোফাসেট, টিভি সেট, কাচ বসানো স্টিলের আলমারি, ড্রেসিং টেবিল আলনা খোলা ডাইনিং টেবিল কাটলারি ইত্যাদি। আমার ধারণা এর আটগুণ মাল অন্তত ওই দোতলা থেকে বেরিয়েছে, আর সে মাল একটা লরিতে কুলোয়নি, এই মাল দেখে অন্তত মনে হল যিনি আসছেন তিনি ছিমছাম থাকতে ভালবাসেন, গৃহিণী শূন্য সংসারে এটাই স্বাভাবিক। লরিতে মালের সঙ্গে এলো সেই মাঝবয়সী না-বাবু না-চাকর গাছের লোকটি।
সেটা ছিল এক শুক্রবারের সকাল। ভাবলাম দুপুর বা বিকেলের মধ্যে বাড়ির মালিকের শুভাগমন হবে। কিন্তু রাতের মধ্যেও তাঁকে বা অন্য কোনো লোককে দোতলার ফ্ল্যাটে দেখা গেল না।
পরদিন শনিবার। সপ্তাহের এই দিনটিতে বাঙালিকে গৃহপ্রবেশ বা বাড়ি-বদল করতে কমই দেখা যায়। সকাল আটটা নাগাদ আমি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে। পর পর তিনখানা গাড়ি পাশের বাড়ির ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়ালো। তার মধ্যে সামনের আর পিছনের চকচকে ফিয়েট গাড়ি দুটো আমার আগেই দেখা। সেলফড্রিভন, পাশে যার-যার স্ত্রী–যাদের এক-জোড়া মেয়ে-জামাই অন্য জোড়া ছেলে-ছেলের বউ হবে বলে বিশ্বাস। মাঝের ডাভ-গ্রেরঙের চকচকে অ্যামবাসাডারখানাও সেলফড্রিভন। চালকের আসন থেকে যিনি নামলেন সকলেরই অনুমান তিনিই ছোট্ট এই নতুন রং-পালিশ করা বাড়ির মালিক হবেন। সকলের অনুমান বলতে আশপাশের প্রত্যেক বাড়িরই একতলা দোতলায় দুই একজন করে নবাগত পড়শীর মুখখানা দেখার আগ্রহে দাঁড়িয়ে গেছল। পাড়ার সকলের সঙ্গেই সকলের মৌখিক ভাব-সাব, তার মধ্যে রিটায়ার করলেও পদস্থ পুলিশ অফিসারের ছাপ থাকায় এই একজন পাড়াগোত্ৰীয় হবেন না, সকলেরই হয়তো এই ধারণা। তাই প্রথম দর্শনে চোখে মেপে নেওয়ার আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছেন, পাশে সেই না-বাবু না-চাকর মানুষটি।
ভদ্রলোক সৌম্যদর্শন এবং ভারিক্কি চালের মানুষই বটে। পাকা হাতে ফুটপাথ-ঘেঁষে গাড়ি থামিয়ে নামলেন। পরনে পাট ভাঙা সাদা পাজামা, গায়ে নেটের গেঞ্জির ওপর দুধ-সাদা ফিনফিনে বুক-খোলা পাঞ্জাবি, বোতামের জায়গায় সোনার চেনে আটকানো সোনার বোতাম, ডান হাতের এক আঙুলে বড়সড় একটা হীরের আঙটিই হবে, অন্য হাতের রিস্টওয়াচ আর ব্যাণ্ড দুইই স্টেনলেস স্টিলের। পায়ে হরিণের চামড়ার শৌখিন চপ্পল। গায়ের রং মোটামুটি ফর্সা, পরিমিত লম্বা এবং স্বাস্থ্যবান, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। চুল ছোট করে ছাঁটলে ব্যক্তিত্বের ছাপ বাড়ে এমন একটা ধারণা পুলিশ অফিসারদের আছে কিনা জানি না। তবে এঁকে ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক দেখাচ্ছে সন্দেহ নেই।
গাড়ি থেকে নেমে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট চোখে নিজের বাড়ি খানা দেখলেন। ততক্ষণে সামনে-পিছনে দুই ফিয়াটের দু-জোড়া দম্পতীও তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের দেখামাত্র কোন্ জোড়া ছেলে-ছেলের বউ আর কোন্ জোড়া মেয়ে-জামাই সেটা এক নজরেই বোঝা গেল। ভাইবোনের মুখের আদল বাপের সঙ্গে মেলে। ভদ্রলোক প্রসন্ন মুখেই ফ্ল্যাট বা বাড়ি সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করলেন বোধহয়, কারণ বাকি চারজনকেই হৃষ্টমুখে মাথা নাড়তে দেখা গেল। নিজের বাড়ি পর্যবেক্ষণের পর ভদ্রলোক পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে চাক্ষুষ বিবেচনার আশাতেই সম্ভবত একবার চারদিকে ঘুরে দেখলেন। আমার সঙ্গে এবং অনেকের সঙ্গেই চোখাচোখি হল বটে, কিন্তু সেটা বিচ্ছিন্ন-ভাবে কারো সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়।
গ্যারাজের পাশের সিঁড়ি ধরে একে একে সকলে চোখের আড়াল হলেন। সকলের কি ধারণা হল সেটা একজনের অভিব্যক্তি থেকেই আঁচ করা যেতে পারে। রাস্তার উল্টো দিকে আমার মুখোমুখি বাড়ির দোতলার সমবয়সী ভদ্রলোকটি ব্যঙ্গোচ্ছল মুখে দুদিকে দুই বাহু প্রসারিত করলেন। অর্থাৎ নাগালের বাইরে একজন মস্ত মানুষ এলেন। গাড়ি তিনটেই হয়তো এরকম মূল্যায়নের কারণ। নিজের গাড়ি, ছেলের গাড়ি আবার মেয়ের গাড়ি। পুলিশ অফিসারের এমন সৌভাগ্য সকলে সাদা চোখে দেখে না। আমার কেবল মনে হল একজন অভিজাত পুরুষ একেবারে কাঁধ-ঘেঁষে কায়েম হয়ে বসলেন। তা বসুন। আমার আর কি যায় আসে। আগের বাসিন্দাকে নিয়েও আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল না, এর বেলায় হয়তো সেটুকু আরো কমবে।
দিন-পনেরো যেতে এটুকু বোঝা গেল নবাগত পড়শীটি যতই রাশভারী পুলিশ অফিসার হয়ে থাকুন, নিজেকে খুব জাহির করার লোক নন। লোকজনের আনাগোনা নেই বললেই চলে। সন্ধ্যার দিকে কেবল দু’জোড়া মুখই আসতে যেতে দেখি। মেয়ে-জামাই আর ছেলে-ছেলের বউ। না-বাবু না-চাকর লোকটি কমবাইণ্ড হ্যাণ্ড। তাকে হাট-বাজার করতে দেখি, আবার গাড়ি চালাতেও দেখি। কোথাও যাবার দরকার না থাকলেও রোজই সে-গ্যারাজ থেকে গাড়ি বার করে, স্টার্ট দেয়, দু-চার মিনিট চালিয়ে আবার গ্যারাজ করে। একটা অল্পবয়সী চাকর আছে, বাড়ির কাজের সঙ্গে গাড়ি ধোয়া মোছাও তার ডিউটির মধ্যে পড়ে হয়তো। কিন্তু তাদের প্রভু অর্থাৎ আমার কাঁধ-ছোঁয়া পড়শীটির অস্তিত্ব প্রায় চক্ষু-কর্ণের অগোচর।