ঘোষ সাহেব তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মৃদু মৃদু হাসছেন।
এমন প্রহসনের একটাই অর্থ। নিজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে তিনি যাকে মর্যাদা দিলেন, সেই আমি ওঁর এই অবহেলিত তিন প্রতিবেশীর কত অন্তরঙ্গ আপনার জন সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হল।
সন্ধ্যার পরে জানান না দিয়ে তাঁর বাড়ির দোতলায় উঠে এলাম। বারান্দায় বসে টিভি দেখছিলেন। আনন্দে উঠে দাঁড়ালেন।–আসুন, প্রায় দু’দিন ট্রেনের ধকল গেছে ভেবে হীরুকে পাঠাইনি, তবু মনে মনে খুব আশা করেছিলাম–আপনি ছিলেন না পাড়া একেবারে অন্ধকার, মানে সকালে রাস্তায় কোলাকুলির ঘটা দেখে তাই মনে হল।
আমিও হাসছি।
দু’পা এগিয়ে এলেন।–আপনি বয়োজ্যষ্ঠ একটা প্রণাম করি?
বাধা দিয়ে কোলাকুলি সেরে নিলাম।
–ওরে হীরু, টিভি বন্ধ কর, পুজোর পরে এলেন, তোর স্পেশাল কিছু আছে নাকি বার কর।
হীরুকেই বললাম, আর একদিন হবে, আজ শরীরের যুত নেই, এক পেয়ালা চা কেবল দিতে পারো।
শোবার ঘরে এসে বসলাম। আমি খাটে ঘোষ সাহেব ইজিচেয়ারে। কালীর ফোটোতে একশ আট জবার মালা। ধূপ-ধুনোর সেই পরিচিত গন্ধ। বাতাসে শুচি স্পর্শ।
–কেমন বেড়ালেন আগে বলুন।
অনেক বারের দেখা জায়গায় বেড়ানো। দু’চার কথায় ও-প্রসঙ্গ সেরে তার খবর জিগ্যেস করলাম।
উনি জানালেন নতুন করে কিছু বুঝছেন না, একই রকম আছেন। গত কাল ট্রিটমেন্টের কোর্স শেষ হয়েছে, স্পেশালিস্ট ডাক্তারকেও কালই ফোন করেছিলেন। তিনি একবার দেখতে চেয়েছেন, কি কি টেস্ট করতে হবে তা-ও লিখে দেবেন।
-কালই চলুন তাহলে?
–অত তাড়ার কি আছে, দুই একদিন বিশ্রাম করে নিন …
–বিশ্রাম নেবার মতো কোনো পরিশ্রম আমার হয়নি, কালই অ্যাপয়েন্টমেন্ট পান কিনা ফোন করে দেখুন।
-আচ্ছা করব। হাসছেন।–আমার চিঠি পেয়েছিলেন?
মাথা নাড়ালাম, পেয়েছি।…উনি লিখেছিলেন, নিজের অদৃষ্টকে ধন্যবাদ, মানুষ কত সহজে আপনার জন হয়ে উঠতে পারে এটুকুও জানতে বাকি ছিল। হেসে এ-প্রশ্নটা করে সেই অনুভূতিটুকুই আবার ব্যক্ত করলেন। জিগ্যেস করলাম, সেই মেয়েটি মানে রাধা এর মধ্যে এসেছিলেন?
গাড়ি পাঠিয়ে দু’দিন আনিয়েছিলাম, সপ্তমীর দিন আর বিজয়ার দিন। ওই দু’রাত এখানেই ছিল, ভিড়ে বিকেলে আর গাড়িই বার করা যায়নি।…তবে অসুখ নিয়ে কথা বলার ফুরসৎ মেলেনি, ওই দু’রাত মেয়ে বউমা আর নাতি নাতনিরাও এখানেই ছিল, বাড়ি জমজমাট, কেবল যাবার আগে যা দু’চার কথা হ’ল–
জমজমাট বাড়িতে সেই মেয়ে এসে দু’রাত ছিল শুনে আমিই যেন সামনের তিন প্রতিবেশীর আর এক দফা কাদা ছোঁড়ার হাত থেকে বাঁচলাম। ফি দু’চার কথা হল শোনার আগ্রহ। ঘোষ সাহেব হাসি মুখেই সেটুকু শোনালেন।…বউমা ঊর্মিলা আর মেয়ে শমী ছেলেমেয়ে নিয়ে তার খানিক আগেই চলে গেছে। যাবার জন্য তৈরি হয়ে রাধা তার কাছে এসে মাথা থেকে পা পর্যন্ত এক প্রস্থ দেখে নিয়ে জিগ্যেস করল, এই চিকিচ্ছেয় একটু ভালো বোধ করছ? ঘোষ সাহেব বিশ্বাসযোগ্যভাবেই মাথা নেড়েছেন, ভালো বোধ করছেন। রাধা আরো এগিয়ে এসে নিজের হাত দু’খানা তাঁর গলার চার দিকে বোলালো, তারপর সেই দু’হাত মায়ের ছবির ওই পায়ে রেখে স্থির হয়ে খানিক দাঁড়িয়ে রইলো। ব্যাপারখানা কি হল বুঝতে পেরেছেন?
–কি?
-আমার সব বালাই মায়ের পায়ে জমা করে দিল। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, বেশি ভেব-টেবনি বড়বাবু–
ভাবলাম এটুকুতেই শেষ। কিন্তু ঘোষ সাহেব আমার দিকে চেয়ে যে-ভাবে টিপটিপ হাসছেন, মনে হল আরো কিছু শুনতে বাকি।
তাই। নিজে থেকেই বললেন, ওর মনে কি আছে বোঝবার জন্য হঠাৎ আপনাকেই টেনে আনলাম। বললাম, আমি খুব ভাবছি টাবছি না, কিন্তু বাইরে বেড়াতে বেরিয়েও আর এক ভদ্রলোক আমার জন্য ভেবে সারা হচ্ছেন।…তখন আপনার কথা এসেই গেল।
আমি উৎসুক।
–শুনেই মশাই বিরক্ত কেবল নয়, রাগ রাগ ভাব। বলল, চিকিচ্ছে করাতে বলেছিলাম করাচ্ছ–ফুরিয়ে গেল, পাঁচ কান করার কি দরকার ছল তোমার?
চেয়ে আছি।
ঘোষ সাহেব তেমনি হাসছেন। তখন চিঠিতে আপনাকে যা লিখেছিলাম ওকেও তাই বলতে একেবারে ঠাণ্ডা। বলল, ভালো বন্ধু মেলা তো ভাগ্যের কথাই, কিন্তু মেলে কই।
ডাক্তারকে ফোন করার কথা আবার মনে করিয়ে দিয়ে নেমে এলাম। ভিতরের অস্বস্তি প্রকাশ করার নয়। মনে ডাক দিয়েছিল বলেই রাধা অন্য ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করানোর তাগিদ দিয়ে ছিল। আমরা কতদূর কি করেছি সে জানেও না। কেবল জানে অন্য ডাক্তার দেখানো হয়েছে, চিকিৎসাও হচ্ছে। কিন্তু সেটা পাঁচ কান হবার ব্যাপারে আপত্তির একটাই কারণ। কেউ কিছু না বললেও রোগ সম্পর্কে এখনো তার মনে কিছু জটিলতার আশংকা থিতিয়ে আছে।
.
একরকমই আছেন স্পেশালিস্ট ডাক্তারকে ঘোষ সাহেব ফোনে আগেই জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয় দফা পরীক্ষা করে তিনি ভরসা বা ভয়ের কোনো কথাই বললেন না। দুই একটা বাদ দিয়ে আগের টেস্টগুলোই আবার করিয়ে নেবার নির্দেশ লিখে দিলেন। তফাৎ কিছু হল কিনা এই রিপোর্ট পেলে বোঝা যাবে।
আট-দশ দিন বাদে সব রিপোর্ট নিয়ে আবার আমরা এক সন্ধ্যায় তাঁর কাছে উপস্থিত। আগের আর পরের রিপোর্ট মিলিয়ে ছোট মন্তব্য করলেন, না, একইরকম আছে দেখছি।
আমি আশান্বিত, তার মানে বিনাইন?
মাথা নাড়লেন।–মনে হয় না, এ দু’মাসের চিকিৎসায় রিপোর্ট গুলোর পিকচার ঠিক এক রকম হবার কথা নয়, আর উনিও আগের তুলনায় অনেকটাই ভালো বোধ করতেন।