একটু থমকে গিয়ে হেসে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, আমার মতো পুলিশ অফিসারকেও বেশ কড়া কথা শোনাতে পারেন দেখছি!
সমস্ত রিপোর্ট নিয়ে আবার সার্জনের কাছে হাজির হবার পর আমাদের দুশ্চিন্তা আরো বাড়ল বই কমল না। রিপোর্টগুলো থেকে তিনি একজনের নাম করলেন যিনি সার্জন নন, কিন্তু এ-লাইনের নাম করা স্পেশালিস্ট ডাক্তার। একটা চিঠি লিখে রিপোর্টগুলো নিয়ে তাঁর কাছে যেতে বললেন। অর্থাৎ যা করার দু’জনে কনসালট করে করবেন।
ফেরার সময় ঘোষ সাহেব হেসেই বললেন, সেধে কি-রকম জড়িয়ে পড়েছেন বুঝতে পারছেন? ব্যাপারখানা বায়োপসির দিকে গড়াচ্ছে–
মনটা সত্যি দমে গেছে। তবু জোর দিয়েই বললাম, এটা করতেই হবে মনে হলে সার্জন আপনাকে সে-কথাই বলতেন, অন্য স্পেশালিস্টের কাছে ওপিনিয়নের জন্য পাঠাতেন না।
গাড়ি চালাচ্ছি। সামনের দিকে চোখ। তবু মনে হল ভদ্রলোক নিজের মনে হাসছেন। হঠাৎ বললেন, দেখুন মশাই, ওপিনিয়ন আমি মোটামুটি পেয়েই গেছি, গাড়ি না পাঠাতে রাধা যেদিন নিজে থেকে চলে এলো আর বলল, দেখতে ইচ্ছা করল তাই খরখর (পা চালিয়ে) চলি এলাম, আর তার পরেই গলার জন্য অন্য ভালো ডাক্তার দেখাবার হুকুম করে গেল, সেদিনই বুঝেছি ব্যাপার সুবিধের নয়। তখন অবশ্য একটু ধাক্কা খেয়েছিলাম, কিন্তু আপনি বললে বিশ্বাস করবেন না, এখন আর খুব একটা উদবেগ নেই–যা হবার হবে।
একটু চুপ করে থেকে বললাম, তার ওপর যখন আপনার এত বিশ্বাস, সময়ে চিকিৎসা করলে আপনি সুস্থ হবেন বলেই তিনি যেচে এসে এই ফতোয়া দিয়ে গেছেন।
–তা হবে।
জিগ্যেস করলাম, মেয়েটির নাম বুঝি রাধা?
হুঁ।
সামনের দিকে চোখ রেখে আবার বললাম, তাঁর মাথায় কাপড় দেখেছি, কিন্তু সিঁদুর-টিঁদুর চোখে পড়েনি। সধবা না বিধবা?
রসিকতার সুরে জবাব দিলেন, একবার নয়, দু’ দুবারের বিধবা, প্রথম বারে তেইশ বছর বয়সে দ্বিতীয়বার সাতাশ বছর বয়সে, অরুচি ধরে না গেলে আরো এক আধবার হতে পারত, শুনেছি যাদের সাধ ছিল তারা কপালী বাবার খাঁড়ার ভয়ে পিছু হটেছে, ওকে আর বেশি উত্যক্ত করেনি।
আমার কান-মন সজাগ। কপালী বাবা নামটা আগেও শুনেছি। বিয়াল্লিশের রাধা যদি এই হয়, সাতাশের চেহারাখানা কল্পনায় আনতে চেষ্টা করলাম। বললাম, আপনার মুখে শুনেছিলাম আপনার জয়নগর থানার বড়বাবু ডাকটাই উনি এখনো ধরে আছেন, তার মানে জয়নগরের মেয়ে আর সেখানেই থাকেন?
–ও যেখানে থাকে সে জায়গাটার নাম ছিল মাতন, জয়নগর আর বিষ্টুপুরের মাঝামাঝি একটা জংলা জায়গা, এখন একটু এদিকে হলে জয়নগর, ও-দিকে হলে বিষ্টুপুর–আশপাশের ওই সব জায়গাই জয়নগর থানার জুরিসডিকশনে। তারপর গম্ভীর গলার রসিকতা, এখন আমার চিকিৎসার জন্য দ্বিতীয় স্পেশালিস্টের কাছে যাবেন কি মাতনের রাধার কাছে, বেশ করে ভেবে নিন।
.
দ্বিতীয় স্পেশালিস্ট ভদ্রলোক আরো প্রবীণ। সব শুনলেন, নিজে পরীক্ষা করলেন, রিপোর্টগুলো খুঁটিয়ে পড়লেন। তারপর সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করলেন। যথা, গ্রোথ যা পাওয়া যাচ্ছে তা বিনাইন কি ম্যালিগন্যান্ট না ট্রানজিটারি সেটা এখন পর্যন্ত ধরা যাচ্ছে না। বিনাইন হলে ভয়ের কিছুই নেই, ম্যালিগন্যান্ট বলেও তিনি ধরে নিচ্ছেন না, কারণ এক বছরের ওপর হয়ে গেল উপসর্গগুলো মোটামুটি একই রকম আছে, চিকিৎসায় বা শুশ্রূষায় কমছে বাড়ছে, কিন্তু এজন্যই আবার ট্রানজিটারি অবস্থার আশঙ্কাটা বাতিল করা যাচ্ছে না
সাদা কথায় এই অবস্থার পরিনামও মারাত্মক হতে পারে। তাঁর মত আপাতত কিছুদিন চিকিৎসা করে দেখবেন, তারপর এই টেস্টগুলোই আবার করানো হবে–ফলাফলের কোনো তারতম্য হয় কিনা দেখার পর তিনি যা বলার বলবেন।
চিকিৎসা বলতে ইনজেকশন আর ওষুধ। তাই চলতে লাগল। ছেলেমেয়ে জানল তাদের রাধা মাসির পরামর্শে বাবাকে অন্য ডাক্তার দেখছে এবং সাধারণ চিকিৎসাই চলছে।
এরই মধ্যে পুজো এসে গেল। পনেরো বিশ দিনের জন্য সপরিবারে আমার বাইরে বেরুনোর প্রোগ্রাম ছিল। ভিড় এড়ানোর জন্য পুজোর দিন সাতেক আগে টিকিট বুক করা ছিল। ডাক্তারের এই ট্রিটমেন্টের কোর্স শেষ হতেও আরোও তিন সপ্তাহ বাকি। তার মধ্যে ফিরে আসা যাবে। মনে বেশ একটু অশান্তি নিয়েই বেরুলাম। সেটা টের পেয়ে ঘোষ সাহেব ঠাট্টা করেছিলেন, বলেন তো রোজ আপনাকে একটা করে টেলিগ্রাম করতে পারি।
এই এক অসুখের ব্যাপার শুনে মনের দিক থেকে দুজনেই কত কাছাকাছি এসে গেছি সেটা অনুভবের বস্তু। দিল্লি হয়ে আমার হরিদ্বারে যাবার কথা। বিজয়ার পর হরিদ্বারে বসে ঘোষ সাহেবের ছোট্ট একখানা চিঠি পেলাম। শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেছেন, নিজের অদৃষ্টকে ধন্যবাদ, মানুষ কত সহজে আপনার জন হয়ে উঠতে পারে এটুকুও আমার জানতে বাকি ছিল। আমি বহাল তবিয়তে আছি, কিচ্ছু ভাববেন না।
লক্ষ্মী পুজোর দিন পাঁচেক পরে ফিরেছি। গাড়ি থেকে নেমে দেখি ঘোষ সাহেব সহাস্য বদনে তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে। চোখাচোখি হতেই সানন্দে দু’হাত মাথার ওপর তুললেন। অর্থাৎ কেবল শুভেচ্ছা জ্ঞাপন নয়, আমাকে নিশ্চিন্তও করতে চাইলেন।
গাড়ি থেকে মালপত্র নামানোর ফাঁকটুকুর মধ্যে লোক-চরিত্রের একটু ছোট প্রহসনের মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খেয়ে উঠলাম। গাড়ি থেকে আমি আমার বাড়ির ফুটপাথে নেমেছি। উল্টো দিকের দুই বাড়ির ওঁরাও যে লক্ষ্য করছেন জানি না। প্রথমে দোতলার অমর গাঙ্গুলী একরকম ছুটেই রাস্তা পার হয়ে এসে আমাকে বুকে জাপটে ধরলেন। কোলাকুলির ঘটা শেষ না হতে হাসি মুখে ও-পাশের দোতলার ভটচায মশাই আর এক তলার রায় মশাইও হাজির। আরো দু’দফা কোলাকুলির ঘটা। যেন আমার ফেরার অপেক্ষায় ওঁরা দিন গুনছিলেন। সাড়ম্বর কুশল বিনিময় সেরে ওঁরা বিদায় নিতে আমি আর একবার আমার পাশের দোতলার দিকে তাকালাম।