মেয়েটির কথা বলতে বলতে ঘোষ সাহেব মুডে এসেছেন বুঝতে পারছি। আমার আগ্রহ বুঝলে পাছে নিজেকে গুটিয়ে নেন তাই একটু হেসে নির্লিপ্ত সুরে বললাম, আপনি এত বড় একজন পুলিশ অফিসার আর মেয়েটি আপনাকে বড়বাবু বলে ডাকেন?
–আর বলেন কেন, হেসেই জবাব দিলেন, আমি তখন জয়নগর থানার ও. সি–ও. সি-কে বড়বাবুই বলে সকলে, ওর ধারণা বড়বাবুর থেকে বড় আর কে? অ্যাসিস্টান্ট কমিশনার ডেপুটি কমিশনারের থেকে এখনো ওর কাছে বড়বাবুই বড়। আরো মজা, ওর মুখে বড়বাবু ডাকটাই আমার মিষ্টি লাগে। কোয়াটার্স-এ থাকতে আমার মেয়ে দুই একবার ওকে শুধরে দিতে চেষ্টা করে বলেছে, তুমি সেই বড়বাবু ধরে আছ কেন মাসি-আমার বাবা যে এখন বড়বাবুর থেকেও ঢের বড়। না বুঝে ও বোকার মতো আমার দিকে তাকাতো, আমার চোখ টেপা বা ইশারা থেকে ও বুঝে নিয়েছে মেয়ে ঠাট্টা করছে।
মেয়েও ওই একজনের পরিচিত এবং মাসি বলে ডাকে শুনে একটু স্বস্তি বোধ করতে চেষ্টা করলাম। শুনলে যদিও আমার উল্টোমুখো বাড়ির অমর গাঙ্গুলী আরো বেশি মুখ মচকাবেন, বলবেন, মেয়ের মাসি অর্থাৎ ভদ্রলোকের পাতানো শালী সম্পর্কটা আরো রসঘন হতে বাধা কোথায়?
বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি। আর কোনোরকম ঔৎসুক্য প্রকাশ না করে বললাম, সার্জনের সঙ্গে কনট্যাক্ট করতে পারলে জানাব। যে-মেয়ের তাগিদে সার্জন দেখাবার সংকল্প তার সম্পর্কে এখনো কিছুই জানি না। অথচ একটু উতলা যে হয়েছি নিজেই টের পাচ্ছি। এটা কোনো অন্ধবিশ্বাসের কারণে নয়।…অংশুমান ঘোষ বিজ্ঞানের ছাত্র, তার ওপর পুলিশের নার্ভ। তাঁর চাকরি জীবনের যে দুটো ঘটনা আমি গল্পে টেনে এনেছি তা অপরাধী জীবনের বুকের তলার ভিন্ন ছবি, কিন্তু ওই দুর্ধর্ষ চতুর অপরাধীদের নাগাল পাওয়া সম্ভব হয়েছিল কেবল তেমনি ইস্পাতকঠিন স্নায়ু আর প্রত্যুৎপন্ন বুদ্ধির জোরে। সেটা নিজে তিনি জাহির করেননি, কিন্তু আমার অনুভব করতে অসুবিধে হয়নি। এই মানুষই একটি অশিক্ষিত গ্রাম্য মেয়ের অঙ্গুলি নির্দেশ পেয়ে বিচলিত একটু হয়েছেন সন্দেহ নেই। নিজের ছেলেমেয়ে বা জামাই ও-কথা বললে তিনি কানেও নিতেন না হয়তো।
অংশুমান ঘোষের শোবার ঘরে বসে প্রথম দিনের আলাপের কিছু কথা আমার কানে লেগে আছে। বলেছিলেন, মাঝ বয়েস পর্যন্ত মনেপ্রাণে উনি পুলিশই ছিলেন, অনেক নিষ্ঠুর কাজ অনায়াসে করে গেছেন, কর্তাদের অবিবেচনায় মন মেজাজ যখন খুব খারাপ সেই সময় একটা ঘটনা আর বিশ্বাসের এক আশ্চর্য নজির দেখে তার ভিতরে কি রকম নাড়াচাড়া পড়ে গেল আর সেই থেকেই মনে জিজ্ঞাসার উৎপাত শুরু হল। সেই ঘটনা আর বিশ্বাসের ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করতে তৎক্ষণাৎ ধামাচাপা দিয়েছিলেন আর রসিকতার সুরে বলেছিলেন পুলিশ অফিসার চাকরি থেকে রিটায়ার করলেও তার এক্সহিউমড হবার ভয় থাকে। এখন আমার বদ্ধ ধারণা সেই ঘটনা আর বিশ্বাসের আশ্চর্য নজিরের সঙ্গে এই গ্রাম্য মেয়েই যুক্ত, এই কারণে অংশুমান ঘোষের মতো দাপটের পুলিশ অফিসারের এই পরিবর্তন, তাঁর মনে অনন্ত জিজ্ঞাসার তৃষ্ণা।
বাড়ি ফিরে কতগুলো শব্দ আমার মাথায় ঘুর পাক খেতে লাগল। কপালী বাবার জংলী কালী…শ্মশান কালী..বড় পীরের মাজার… বিবি মায়ের থান…জয়চণ্ডীর মন্দির। এগুলো সব কোথায়? জয়নগর বা তার কাছাকাছি কোথাও হতে পারে। কারণ ঘোষ সাহেব যখন জয়নগর থানার ও. সি. সকলে তাকে বড়বাবু ডাকত, আর সেটাই সব থেকে মর্যাদার ডাক জেনে এই মেয়েও তাই বলে।…সেই তল্লাটের মেয়ে হলে মোটরে কলকাতায় যাতায়াতে কম করে আড়াই ঘণ্টার পথ। হীরু ওকে সেখান থেকে নিয়ে আসে দিয়ে আসে।
সার্জনের সঙ্গে সেই সন্ধ্যাতেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলাম। গোপন রাখার তাগিদে নিজের ড্রাইভারও নিলাম না। কারণ দু’বাড়ির দুই ড্রাইভারের সঙ্গে ইতিমধ্যে ভাব-সাব হয়ে গেছে। আমি চালাচ্ছি, ঘোষ সাহেব পাশে। সার্জন সম্পর্কেই আবার একটু খোঁজ নিলেন তিনি, কত বয়েস কত দিনের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। জবাব দিয়ে তাকে আরো একটু নিশ্চিন্ত করার জন্য জানালাম, ফরেনের ডিগ্রিটিগ্রির জন্য বলছি না, এর থেকে বেশি আস্থা আর আমার কারো ওপর নেই, আমার একটি নিকট আত্মীয়ের কাঁধ আর ঘাড়ের ক্যানসার ইনি অপারেশন করে ভালো করেছেন।
হেসে উঠলেন।–নিশ্চিন্ত হলাম, গলা কেটে বাদ দিলেও ক্যানসারটা অন্তত সারবে।
না বলাই ভালো ছিল মনে হল।
সার্জন খুব যত্ন করেই পরীক্ষা করলেন। গত এক বছরের রিপোর্ট নিলেন। থ্রোট স্পেশালিস্টের প্রেসকৃপশনগুলো দেখলেন। তারপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার এক মস্ত ফর্দ দাখিল করলেন। এক বড় প্রতিষ্ঠানের নাম করে নির্দেশ দিলেন, এগুলো সব করিয়ে আনুন, সবগুলো টেস্ট হতে আট-দশ দিন লাগতে পারে, তারপর আসুন।
সোজাসুজি জিগ্যেস করলাম, আপনার কি মনে হয় বলুন?
জবাব দিলেন, ঘাবড়াবার মতো কিছু না-ও হতে পারে, আবার এ-ও বলা উচিত নেগলেক্ট করা কোনো মতেই উচিত হবে না–আগে এই টেস্টগুলো সব করিয়ে আনুন।
ভদ্রলোকের ছেলেমেয়ে কাউকে জানতে না দিয়ে এ-পর্বও নির্বিঘ্নে সারা হল। ঘোষ সাহেব বার বারই বলেছেন, আপনার সময় নষ্ট পেট্রল নষ্ট, বড় বেশি জুলুম করা হয়ে যাচ্ছে।
শেষে বাধ্য হয়ে বলেছি, আপনি আর একবার একথা বললে আপনার ছেলেময়েকে জানাবো, তারাই দায়িত্ব নেবে।