উদগ্রীব হয়ে শুনছি।–তারপর?
জবাব দিলেন, কাউকে কিছু বললে মেয়েটা কেন কি জন্য এসব প্রশ্ন পছন্দ করে না। ঝাঁজি মেরে বললে, অত কথায় কাজ কি তোমার বড়বাবু, যা বললাম করো দিকিনি, করে আমাকে নিচিন্দি করো, আমি দৈবী জানি না গণা জানি যে আগে থাকতি ভালো-খারাপ বাখাই দিব? মনে ডাক দেছে যখন দুটো একটা ভালো ডাক্তার দেখাও, তোমার তো অভাব কিছু নাই।
আরো কিছু শোনার আশায় ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে আছি। এর মতো রাশভারী লোককে এক গ্রাম্য মেয়ে ঝাঁজি মেরে তুমি তুমি করে কথা বলে, বড়বাবু বলে ডাকে। কিন্তু যা বলে উনি সেটা অবহেলা করতে পারেন না তা তাঁর পরের কথায় স্পষ্ট। বললেন, আপনার হয়তো হাসি পাচ্ছে, কিন্তু ওর মনে ডাক দেওয়াটা আমরা যারা জানি, তুচ্ছ করতে পারি না, বরং শোনার পর থেকে একটু দুশ্চিন্তাই হচ্ছে।
দুশ্চিন্তা আমারও হচ্ছে এটা প্রকাশ করলাম না। বললাম, দেখুন আমরা শিক্ষাদীক্ষার গর্ব করি, কিন্তু কত সময় একটা শিশুও বড় রকমের এক-একটা সহজ ভুল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যিনি বলেছেন আপনাকে তাঁর দৃষ্টি অন্তত স্বচ্ছ এটা মানতেই হবে–আপনার এখানে আসা থেকেই শুনছি গলার ট্রাবল-এ ভুগছেন, থ্রোট স্পেশালিস্টের চিকিৎসায় সারছে না, কখনো কমছে, কখনো বাড়ছে, আমাদেরই সেকেণ্ড ওপিনিয়ন নেবার কথা বা সার্জন দেখানোর কথা ভাবা উচিত ছিল–অথচ এই রুটিন ব্যাপারটা আমার আপনার কারোই মনে আসেনি। যাক, আপনি উতলা হবেন না, যাকে দেখাচ্ছেন তিনি থ্রোট স্পেশালিস্টই, তার রিপোর্ট নিয়ে আপনাকে আমি আমার বিশেষ পরিচিত এ-লাইনেরই খুব নামকরা এক সার্জনের কাছে নিয়ে যেতে চাই।
একটু চেয়ে থেকে হালকা সুরে জিগ্যেস করলেন, এ-লাইনের মানে সেই লাইনের?
অগত্যা জোর দিয়েই বললাম, হ্যাঁ সেই লাইনের, আপনার মনে কি ডাক দিচ্ছে সেটা নিজেদের মধ্যে গোপন করে লাভ কি, সোজা হাইকোর্টে গিয়ে হাজির হওয়া ভালো।
–ঠিকই বলেছেন।…আপনার এই ক্যানসার স্পেশালিস্ট সার্জনের চেম্বার কোথায়?
বললাম। কোন্ বড় হাসপাতাল আর কোন্ কোন্ নামী নার্সিং হোমের সঙ্গে অ্যাটাচড তাও বললাম। জানালাম, আজকের মধ্যেই আমি ফোনে কনট্যাক্ট করতে চেষ্টা করব।
করুন…তবে কাটা-ছেঁড়া মানে বায়োপসি করতে চাইলে ছেলেমেয়ে দুটো ভয়েই আধমরা হয়ে যাবে।
করতে চাইলেই আপনি গলা পেতে দেবেন তার কি মানে, তখন হাইকোর্টের ওপরে সুপ্রিম কোর্ট আছে–আবার হয়তো এখানে গিয়েই দেখবেন কেস ডিসমিসড, আপনার কিছুই হয়নি। তবে এটা ঠিক, আপনার ছেলে-মেয়েকে আপাতত কিছুই না জানানো ভালো।
–তা তো ভালো, কিন্তু হীরু ব্যাটাই বলে দেবে, কোথায় কোন্ ডাক্তারের কাছে গেছি–নিজে ড্রাইভ করলেও ও সঙ্গে থাকেই, নইলে মেয়েটা খুব রেগে যায়।
-ব্যস, ও-ভাবনাও শিকেয় তুলে রাখুন, এ ব্যাপারে আপনার গাড়ি বেরুবেই না, আপনি আমার সঙ্গে আমার গাড়িতে যাবেন, আর সেটা যে-কোনো অজুহাতে হতে পারে।
খুব খুশি।
ফেরার সময় জিগ্যেস করলাম, ওই যে-মেয়েটির কথা বললেন তার বয়েস তো বেশি না–কোনো সাধিকা নাকি?
সকৌতুকে তাকালেন, বয়েস কত মনে হয় আপনার?
গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে ঢুকতে আর বাড়ি থেকে গাড়িতে উঠতে যেটুকু দেখা। তবু যা মনে হয়েছে তাই বললাম।-আঠাশ তিরিশের মধ্যে?
-ওর বয়েস এখন বিয়াল্লিশ, কিন্তু সাধিকা আপনি কাকে বলেন? সাধনা যোগ বিভূতি-টিভূতি আছে এমন তো? তার ধারে কাছেও না, দুতিন ক্লাস পড়া অজ গাঁয়ের মেয়ে, গ্রাম্য কথাবার্তা, জাতে জলচলও নয়–আর চরিত্র নিয়ে ওর গায়ে কাদা ছোঁড়াছুড়িও বড় কম হয়নি। ঘোষ সাহেব হাসলেন একটু।–কালোর ওপর মুখখানা কেমন মিষ্টি আর এ বয়সেও কেমন সেক্সি ফিগার লক্ষ্য করেছেন তো? বয়স কালে অনেক হারামজাদার মুণ্ডু ঘুরেছে–
সন্তর্পণে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। গাঁয়ের লোক আর কত পিছিয়ে, শহরের শিক্ষিত প্রতিবেশীরাও যে এই মেয়েকে নিয়ে এ বয়সের পুলিশ সাহেবের মুণ্ডটি ঘুরে আছে ভাবছেন আর রসের কাদা ছোঁড়াছুড়ি করছেন এ-তো আর বলার কথা নয়।
কয়েক পা এগিয়ে ঘোষ সাহেব নিজে থেকেই বললেন, তবে একটা কথা আপনি ঠিক বলেছেন, মেয়েটার যেমন স্বচ্ছ দৃষ্টি তেমনি সহজ বুদ্ধি, ক্লেয়ারভয়েন্স বলে একটা কথা আছে না–দূরের জিনিস দেখতে পায়, দূরের কথা শুনতে পায়–সেই গোছের–হঠাৎ হঠাৎ জোরের সঙ্গে কিছু বলে বসে যখন মনে হবে কি হতে যাচ্ছে চোখে দেখতে পাচ্ছে বা কানে শুনতে পাচ্ছে–জিগ্যেস করলে বলে, ও কিছু না। কপালী বাবার জংলী কালী আর বিষ্টুপুর শ্মশান কালীর কাছে, বড় পীরের মাজারে বিবি মায়ের থানে, আর জয়চণ্ডীর মন্দিরে হাজার হাজার মানুষের কাতর প্রার্থনা মানত শুনতে শুনতে আর দুঃখ ব্যথা শোকের মুখগুলো দেখতে দেখতে এখন অনেকটা বুঝতে পারে কার ভিতরে কি যন্ত্রণা। যে মা ছেলেকে যম-দোর থেকে ফেরাবার প্রার্থনা বা মানত নিয়ে আসে আর যে লোক মামলা জেতার আরজি নিয়ে আসে–তাদের মুখের ভাব কি এক রকম হয়? আর ওর বিশ্বাস, মা-কালী বা বড়পীর বা বিবি-মা অথবা জয়চণ্ডী মা অনেক সময় ওকে চোখে আঙুল দিয়ে অনেক কিছু দেখিয়ে দেয় বা বলে দেয়–অবশ্য যখন ও খুব মন দিয়ে তাদের ডাকে। ওর বুদ্ধি পরামর্শগুলোও জল ভাতের মতো সহজ সরল, তাইতেই উপকার পেয়ে অনেকের তাক লেগে যায়। ও বলে, অবাক হবার কি আছে, বুনো ওল খেয়ে গলা ফুললে তাকে তেঁতুল গুলে খেতে বলব না তো কি রসগোল্লা খেতে বলব?