অমর গাঙ্গুলী নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন। মেজাজ চড়লে তাঁর কথাবার্তা বরাবরই একটু বেপরোয়া ধরনের। প্রসঙ্গ ধামাচাপা দেবার চেষ্টা ভাবলেন। জেরার সুরেই জিগ্যেস করলেন, পুলিশ সাহেবের ছেলে-ছেলের বৌ বা মেয়ে-জামাই থাকতে মেয়েটিকে কখনো আসতে-যেতে দেখেছেন?
একটু ভেবে জবাব দিলাম, ঠিক মনে পড়ছে না, বোধহয় না–
–বোধহয় না, দেখেননি। সাহিত্যিক হয়ে আপনি বয়েসের সার্টিফিকেট দাখিল করবেন ভাবিনি–এবার বলুন, ভক্তিমূলক গান শুনতে হলে মেয়েটিকে শোবার ঘরে এনে বসিয়ে পর্দা থাকা সত্ত্বেও সামনের দিকের দরজা বন্ধ করার দরকার হয়? ভক্তিমূলক গান যদি একটু-আধটু আমাদেরও কানে আসে তাতে আপত্তির কোনো কারণ থাকতে পারে?
আমার কান গরম। প্রথমে ইচ্ছে করল ভদ্রলোককে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলি। কিন্তু নিজের স্বভাবে এটুকু জোরের অভাব। তাছাড়া থমকাতেও হল একটু।–গানের সময় সামনের দরজা বন্ধ না করা হলে বারান্দায় দাঁড়িয়েও আমি স্পষ্ট শুনতে পাই না কেন? এই লোকের সামনে বসে চিন্তার জট ছাড়াতে চেষ্টা করে লাভ নেই।
খানিক বাদে ভদ্রলোক বিজয়ী বীরের মতোই উঠে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন, পাড়ায় পাঁচ রকম কথা ওঠে, আপনার ও বাড়িতে যাতায়াত আছে তাই আপনাকে বলা– যাক, আপনি এ সবের সাতে পাঁচে নেই যখন যেতে দিন।
এই ক’মাসের মধ্যে অংশুমান ঘোষের দোতলার শোবার ঘরে আমি কতোবার গিয়ে বসেছি এখন আর হিসেব নেই। বললে একটুও অত্যুক্তি হবে না, যতক্ষণ থাকি যতক্ষণ বসি, একটা শুচিতার স্পর্শ আমায় ঘিরে থাকে। ধূপধুনো একশ-আট জবার মালা গলায় কালীর ছবি বা ওই ক’টা বইপত্র দেখে নয়। এ-সবই আমার নিজের বাড়িতেও আছে, আর পূজা-পার্বণের অনুষ্ঠানও ঢের বেশিই হয়। কিন্তু এরকম একটা শুচিতার অনুভূতি ঠিক মনে আসে না। অমর গাঙ্গুলীর মুখে ও-রকম শোনার পরেও ওই ঘরে কোনোরকম ব্যভিচার কল্পনা ন্যক্কারজনক মনে হয়। এরপর থেকে ওই মেয়েটির সম্পর্কে আমার নিজের কৌতূহল একেবারে ধামাচাপা। অংশুমান ঘোষ আমার সঙ্গে যতই অন্তরঙ্গভাবে মিশুন, মানুষটা তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ধরেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অনেক সময় মনে হয়েছে ভদ্রলোক মুখের দিকে চেয়ে মনের অনেকখানি দেখতে পান। ও-প্রসঙ্গ তুলে কোন বিপাকে পড়ব কে জানে, তার থেকে মুখ সেলাই করে থাকাই ভালো।
২. বড় রকমের দুর্ভাবনা
সাত আট মাসের মাথায় ভদ্রলোককে নিয়ে আমার বড় রকমের দুর্ভাবনার কারণ ঘটল। তার গলা নিয়ে অশান্তি বাড়ছেই। গলার স্বর সত্যিই কেমন ফ্যাঁসফেঁসে হয়ে যায়। তখন চাপ ধরে, স্বস্তিতে খেতেও পারেন না। অবশ্য ব্যথা বেদনা নেই। আমার আর তার নিজেরও ধারণা ঠাণ্ডা খাওয়ার থেকেই এরকমটা হয়। একটু ভালো থাকলেই ফ্রিজের জল ছাড়া মুখে রোচে না, দুধের গেলাস আগের দিন রাত থেকে ফ্রিজে ঠাণ্ডা হতে থাকে, পরদিন সকালে খান। ফলটলও ঠাণ্ডা খেতে ভালবাসেন। অস্বস্তি শুরু হলে এগুলো বন্ধ করেন, আর আনুষঙ্গিক চিকিৎসায় একটু ভালো থাকেন। কিন্তু ইদানীং ট্রাবলটা একটু ঘনঘন হচ্ছে। তবু এজন্য তাঁর নিজের খুব একটা দুশ্চিন্তা হয়নি বলে আমি মাথা ঘামাইনি।
কিন্তু সেদিন একটু ধাক্কা খেলাম। লেকে বেড়াতে বেড়াতে খুব নিস্পৃহ মুখে বললেন, আপনার কোনো থ্রোট স্পেশালিস্ট আর ভালো জেনারেল সার্জন জানাশোনা আছে?
মুখের দিকে চেয়ে দুশ্চিন্তার ছিটেফোঁটাও দেখলাম না। বললাম থ্রোট স্পেশালিস তো দেখাচ্ছেন, সার্জন দিয়ে কি হবে?
–সেকেণ্ড ওপিনিয়নের জন্য আর একজন থ্রোট স্পেশালিস্টের কথা ভাবছি–তারপর দরকার হলে একজন সার্জনও দেখাব।
হাঁটা থামিয়ে আমি থমকে তাকালাম। সামনে একটা খালি বেঞ্চ দেখে তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে বসলাম, নিজেও বসলাম।–কি ব্যাপার বলুন তো, ট্রাবলটা খুব বেড়েছে?
তিনি হেসে উঠলেন।–এই জন্যেই মুখ খুলতে চাই না মশাই, ছেলে মেয়ে জামাইরা শুনলে ঘাবড়াবে বলে আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম–ট্রাবল তো বাড়েইনি, এখন বরং কম–
–তাহলে অন্য থ্রোট স্পেশালিস্ট আর সার্জন দেখানোর কথা কেন?
অল্প অল্প হাসতে লাগলেন। তারপর আমার দিকে একটু ঘুরে বসে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, কারো কারো মনে আগে থাকতে ভালো-মন্দ বা আপদ-বিপদের ছায়া পড়ে এ আপনি বিশ্বাস করেন।
বললাম, এমন কথা শুনেছি কিন্তু এমন কাউকে চোখে দেখিনি।
–আমি দেখেছি–যত দেখেছি ততো অবাক হয়েছি–বিজ্ঞান মানি, কিন্তু এ মানা শক্ত, না মানা আরো শক্ত।
হঠাৎই একটি মুখ মনে পড়ল। অতি সাধারণ বেশবাসের এক রমণীর মুখ। এই সুযোগ। দুশ্চিন্তার প্রসঙ্গ ভুলে জিগ্যেস করলাম, সেই একজন পুরুষ না মেয়েছেলে?
হাসতে লাগলেন। বললেন, কথাটা তুলে ভালো করলাম না, লেখকের নাক-কান সজাগ দেখছি। মেয়েছেলে মশাই মেয়েছেলে আমার বাড়িতে তাকে আসতে-যেতে দেখেন না তা-ও মনে হয় না।
ইদানীং একটু বেশিই আসতে-যেতে দেখছি। স্নায়ুর উত্তেজনা ঠাণ্ডা করার চেষ্টা আমার। স্বাভাবিক সুরে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কি কোনো বিপদের ছায়া দেখছেন?
–দেখলেও তা কি বলবে! দেখতে ইচ্ছে করলে আমি তাকে গাড়ি পাঠিয়ে আনাই, কিছুদিন আগে এক দুপুরে হঠাৎ নিজে থেকে হাজির। বলল, দেখতে ইচ্ছা করল, খর-খর চলি এলাম। তা গলা লয়ে অত ভুগতেছ, এবারে এট্টু ভালো করে চিকিচ্ছেয় মন দাও দেখি। শুনে আমি একটু ধাক্কাই খেলাম, অমন ঠাণ্ডা মেয়েকে খুব সুস্থির মনে হল না, কিছু একটা উদবেগ নিয়ে ছুটে এসেছে বুঝতে পারছি। বললাম, ভালোই তো আছি, হঠাৎ এ কথা কেন, কিছু খারাপ-টারাপ চোখে পড়ছে নাকি?