প্রশান্তবাবু হাসি মুখেই জবাব দিয়েছেন, বলে থাকলেও তো সত্যি কথাই বলেছিস, তোর রাগ হবার কি হল।
এমন প্রচারের যা ফল, তার উত্তেজনা ঠাণ্ডা হতে সময় একটু লাগবেই। প্রথম দিনকতক তো বাড়ির সামনেই কত চেনা অচেনা মেয়েপুরুষের ভিড়। অবস্থা জানানোর জন্য সুশান্তর দুই বন্ধুকে নিচের দরজায় মোতায়েন রাখতে হয়েছে। এদিকে মুহুর্মুহু টেলিফোন। প্রশান্তবাবুর লেখার ঘর থেকে টেলিফোন অবশ্য সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। কারণ শোবার ঘরের পরেই লেখার ঘর। তবু ফোন এলে এ ঘর থেকেও রিং শোনা যায়। ফোনে খবর জানানোর দায়িত্ব অনীতার অথবা ইন্দিরার। তৃতীয় দিনে একটু সুস্থ হবার পর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পঞ্চাশ-ষাটটা করে ফোন আসার খবর প্রশান্তবাবু পেয়েছেন। ফোনে কারা কারা খবর নিচ্ছে নোট রাখা উচিত এবং এই উচিত কাজে গাফিলতি হয়নি। সমবয়সী আর অনুজ লেখক, পাবলিশার, ছোট বড় মাসিক সাপ্তাহিক পত্রের সম্পাদক, সিনেমার পরিচালক প্রযোজক, প্রশান্তবাবুর। স্নেহভাজন অভিনেতা অভিনেত্রী গায়ক গায়িকারা সকলেই বাড়িতে এসে খবর নেবার কর্তব্য পালন করে চলেছে। রোগীর সঙ্গে দেখা করা নিষেধ। ফলে তাদের রোগীর খবর জানানোর দায়িত্ব ইন্দিরার বা ছেলেমেয়ের। প্রত্যহ কারা কারা খবর নিতে এলো। ইন্দিরা সন্ধ্যার পর সময় বুঝে স্বামীকে বলেন।
এমন একটা অবস্থার মধ্যে পড়ে প্রশান্ত মিত্র হাল ছেড়ে আসমর্পণ করা ছাড়া আর কি করতে পারেন? প্রচুর সিগারেট খেতেন। পনের দিনের মাথায় ডাক্তার তিনটে পর্যন্ত অনুমতি দিয়েছে। এ সপ্তাহ থেকে পাঁচটা। তাতেও ইন্দিরা আর ছেলেমেয়ের। বেজায় আপত্তি। একটু আধটু ড্রিংক করা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছল। ডাক্তারের মতে এ রোগে সিগারেটের থেকে ড্রিংক কম ক্ষতিকর–আরো কিছু দিন গেলে একটু আধটু খাওয়া চলতে পারে। ইন্দিরা আর ছেলেমেয়ে ওই ডাক্তারের ওপর রেগে আগুন। তাদের ধারণা, ডাক্তার নিজে খায় বলেই অমন উদার। ছেলে তার এক বন্ধুর ডাক্তার বাবার সঙ্গে কথা বলে বাড়িতে এসে ঘোষণা করল, এই ডাক্তার আর চলবে না, বাবার মুখ চেয়ে ফতোয়া দেয়, আমি খুব ভালো করে জেনে এসেছি ড্রিংক সিগারেট কোনোটাই একদম চলা উচিত নয়।
মেয়ে আর মায়ের কাছে এই ফতোয়াই অভ্রান্ত। প্রশান্তবাবু মনে মনে বিরক্ত। বাপের পয়সায় ছেলে দিনের মধ্যে কপ্যাকেট সিগারেট ওড়ায় ঠিক নেই–লুকিয়ে চুরিয়ে ড্রিংকও একটু আধটু চলে কিনা সে সম্পর্কেও একেবারে নিঃসংশয় নন। কিন্তু মুখে তিনি বাদ প্রতিবাদ কিছু করেন না। এখন বে-কায়দায় পড়েছেন–সময় হলে নিজের যা করার করেই যাবেন এ ওরাও ভালো করেই জানে। জানে বলেই এত কড়া নজরে এখন।
কাঠের টুলে দুপা তুলে দিয়ে দূরের আকাশের দিকে চেয়ে গা ছেড়েই শুয়েছিলেন প্রশান্ত মিত্র। মাথার মধ্যে সেই হিজিবিজি ব্যাপারটা শুরু হয়ে গেল। হিজিবিজি ব্যাপার বলতে কতকগুলো এলোমোলো চিন্তা। কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল নেই, এমন সব আধা ঘুমের মধ্যে যেমন অজস্র ছাড়া-ছাড়া চিত্র ভেসে ওঠে আবার মিলিয়ে যায়, তেমনি কাউকে বলেন নি, একেবারে ছেলেবেলা থেকে এ-রকমটা হয়ে আসছে।
একশ বিক্ষিপ্ত চিন্তার মিছিল মগজের মধ্যে যেন মুর্তি ধরে সার বেঁধে চলতে থাকে। মনষের চরিত্র বিস্তারে সিদ্ধহস্ত শিল্পী তিনি। যে চরিত্র কলমের ডগায় অবয়ব ধরে, তার ভেতর-বার পাঠককে আয়নায় দেখিয়ে দিতে পারেন। অতিবড় রূঢ় সমালোচকও চরিত্র বিশ্লেষণে প্রশান্ত মিত্রর মুক্তি নেই ভাবেন। অনেক সময়েই তারা লেখেন, ফের চরিত্রের গভীরতম অন্তঃপুরে অনায়াসে ঢুকে পড়ার যাদুকাঠিটি এই এক লেখকের হাতের মুঠোয়। আর তারই মগজের মধ্যে এমন এমন এলোমেলো হিজিবিজি ন্তির মিছিল সার বেঁধে চলতে থাকে এ নিজের কাছেই বরাবর একটা কৌতুকের ব্যাপার!
নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন প্রশান্তবাবু। মাথায় একটা মতলব এসেছে। ওই এলোমেলে, অথচ জীবন্ত চিন্তার মিছিলকে যদি কাগজে কলমে ধরে রাখা যায় তো কি দাঁড়ায়? যেমন ভাবা তেমনি কাজ। মহেশকে ডেকে হুকুম করলেন, আমার কালো নোটবই অর পেনটা দিয়ে যা–
মহেশ দ্বিধান্বিত। মনিব এটা উচিত কাজ করছেন না, আর মা শুনলে বকবেন এ সে-ও জানে।
কি বললাম কানে গেল?
মেজাজের আভাস পেয়ে মহেশ ঘর থেকে মস্ত কালো নোটবই আর কলম রেখে গেল। এ নেটবইটা বাড়ির সকলেরই খুব চেনা, কিন্তু কেউ আর এখন এটা খোলে না। লেখার কোনো প্ল্যান বা প্লট মাথায় এলে এতে লিখে রাখেন। কিন্তু নোট করার পদ্ধতি এন বিচিত্রি যে দেখে বা পড়ে কারোই তেমন বোধগম্য হবে না। জ্যামিতিক নক্সার মতো মনে হবে। তার মধ্যে দুচারটে নাম, দুচার অক্ষরে একটা-দুটো ঘটনা, তার মধ্যে অ্যারো টেনে কোথাও সার্কেল কোথাও ট্রায়েঙ্গেল কোথাও বা রেকট্যানে তিনশ পাতার লম্বা বাঁধানো এই নোটবইয়ের প্রায় দুশ পাতা এই গোছের প্লটের নক্সায় বোঝাই। আর তার প্রায় সবগুলোতেই লাল দাগ, মারা। অর্থাৎ যে প্লট বা প্ল্যানগুলো নিয়ে গল্প বা উপন্যাস লেখা হয়ে গেছে তাতে ওই লাল দাগ পড়ে। ইন্দিরা আর ছেলেমেয়েও তার এই প্ল্যান অথবা প্লটের বই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। কিন্তু কিছুই বোধগম্য হয় না বলে কৌতূহল গেছে।