প্রশান্ত মিত্র হেসে মাথা নাড়লেন, ঠিক আছে। বললেন, আমার চিন্তা নিয়ে বেরিয়ে তুমি আবার গাড়ি-চাপা পড়ো না।
ইন্দিরা ব্যস্ত পায়ে চলে গেলেন। কিন্তু আধ মিনিটের মধ্যেই আবার ফিরলেন। হাতে একটা ছোট টুল। পায়ের সামনে ওটা পেতে দিয়ে বললেন, যখন ইচ্ছে হবে পা তুলে বোসো–আর ভালো কথা, আমি বেরুচ্ছি, এই ফাঁকে লুকিয়ে একটা সিগারেট খেলেও কিন্তু ধরা পড়ে যাবে–মহেশ ঠিক আমাকে বলে দেবে।
প্রশান্ত মিত্র মুখ টিপে হেসে বললেন, পি. এমএর আদেশ শিরোধার্য।
-আ-হা, পি. এমএর কথা কত শোনো তুমি! এ-কানে ঢুকলে ও-কান দিবে বেরোয়–শুনলে আর এই বিপাকে পড়তে হত না।
চলে গেলেন। পি, এম অর্থাৎ প্রাইম মিনিস্টার। নামে মিল, তাই ইন্দিরা গাঙ্গ। যেদিন থেকে প্রধানমন্ত্রী সেই দিন থেকে ঘরের এই রসিকতা চাল। প্রশান্তবাবু সময়ে সময়ে এখনো ঠাট্টা করেন, ইন্দিরা সাম্রাজ্যের তবু একবার পতন হয়েছিল, মিত্র সাম্রাজ্যের পতন বলে কোনো কথা নেই। তাই পেয়ে ছেলেমেয়ে দুটো পর্যন্ত ওই নাম নিয়ে ঠাট্টা-তামাসা করে।
গত চার সপ্তাহ ধরে বাড়ির বাতাসে চাপা উত্তেজনা থিতিয়ে ছিল। সম্ভাব্য শোকের উত্তেজনা। শোক ঠেকানোর উত্তেজনাও বলা যেতে পাবে। মোট কথা, সমস্ত ব্যাপারটাই প্রশান্তবাবুর বিবেচনায় একধরণের উত্তেজনা গোছেরই মনে হয়েছিল। হঠাৎ সত্যি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বিনা নোটিসে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠেছিল। বাঁ-কাঁধে আর বুকের বাঁদিকে একটা যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল। বেজায় গরম লাগছিল। ঘাম হচ্ছিল। সমস্ত শরাবে যেন পিন ফোঁটানো হচ্ছিল। এ রোগ তিনি চেনেন। বাবা এই রোগে গেছেন। এক শালা গেল বছর এই রোগে গেছে। অন্তরঙ্গ এক খুড়তুতো ভাই ছমাস আগে গেছে। গত দেড় বছরের মধ্যে দুজন সতীর্থ অর্থাৎ প্রবীণ সাহিত্যিক আর একজন কবিবন্ধু এই রোগে চোখ বুজেছে।
তাই সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকে ডেকে তিনি কি হয়েছে বলেছেন। তারপর শুধু বলেছেন, মনে রেখো, যাই হোক কক্ষনো হাসপাতালে নয়।
তারপর আর কথা বলার শক্তি ছিল না। কিন্তু জ্ঞান পুরোমাত্রায় ছিল। দশ মিনিটের মধ্যে পাড়ার ডাক্তার এসেছে। আধঘণ্টার মধ্যে দুজন বড় ডাক্তার। যে লোকের নাম ডাক আছে তার বেলায় অন্তত তড়িঘড়ি বড় ডাক্তার কলকাতায় মেলে। পটাপট কটা ইনজেকশান দেওয়া হল প্রশান্তবাবু টের পেয়েছেন। তারপর দুটো দিন ঘুম আর ঘুমের ঘোরে কেটেছে।
তৃতীয় দিনে একটু সুস্থ হবার পর থেকে চিকিৎসার আড়ম্বর আর সেই সঙ্গে এই চাপা উত্তেজনা দেখে যাচ্ছেন। দুদিনের সমাচারও শুনেছেন। দুজন বড় ডাক্তারই রোগীকে তক্ষুনি হাসপাতালে সরাতে চেয়েছিল। ইন্দিরা বেঁকে বসতে তা হয়নি। দুজন ডাক্তারই দস্তুরমতো অসন্তুষ্ট তাতে। তারা ছেলেমেয়েকে ডেকে বলেছে, এ অবস্থায় পেশেন্টকে বাড়িতে রাখা নির্বোধের কাজ হবে। ছেলেমেয়ে ঘাবড়ে গিয়ে মাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল। ইন্দিরার এক কথা, চিকিংসা বাড়িতেই হবে–তার জন্যে দশগুণ খরচ হয় হোক-হাসপাতালে নয়।
হাসপাতালে কেন নয় ছেলেমেয়েও মোটামুটি আঁচ করতে পারে। না থেকে শুরু করে আত্মীয়-পরিজন আর বাবার বন্ধুদের এই রোগে যে কজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদের একজনও জীবিত অবস্থায় ফেরেনি। বাবা খোলাখুলি বলতেন, যাবার সময় হলে কোনো পাতাল থেকেই কেউ ফিরবে না–আর কিছু হলে কেউ হাসপাতালে নেবার নামও করবি না।
প্রশান্তবাবু নিজেও জানতেন হাসপাতাল সম্পর্কে এরকম একটা ধারণা থাকা কোনো শিক্ষিত মানুষের উচিত নয়। এমন অনেক রোগ আছে যার যথাযথ চিকিৎসা আর আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা শুধু হাসপাতালেই হতে পারে। কিন্তু হাসপাতাল নামটই তাঁর ব্যক্তিগত অ্যালার্জির মতো। ইন্দিরারও ভয়, জ্ঞান হবার পর স্বামটি যদি দেখেন হাসপাতালে বা নার্সিং হোমে আছেন, তক্ষুনি আবার অঘটন ঘটে যেতে পারে।
যাই হোক, প্রশান্ত মিত্র বাড়ির শয্যাতেই ফাড়াকাটিয়ে উঠলেন। ফতা কাটিয়ে উঠেছেন এ ধারণা শুধু তার নিজের-বাড়িতে আর একজনেরও না। তার ওপর বড় ডাক্তাররা নাকি বলে গেছেন, আরো কিছুদিন না গেলে একেবারে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। এই আরো কিছুদিনটা কত দিন তাই নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রশান্তবাবুর।
দুশ্চিন্তা নিজের শারীরিক দিক ভেবে নয়, চিকিৎসার আড়ম্বর, স্ত্রী ছেলেমেয়ে আর খুব ঘনিষ্ঠ দুচারজনের গার্জেনগিরির দাপটে। ডাক্তাররা সম্পূর্ণ সুস্থ ঘোষণা করলেও আর চলাফেরা কাজকর্মের স্বাধীনতা দিলেও এরা তা মানবে কিনা সন্দেহ। একটু অনিয়ম করা হয়েছে মনে হলে ইন্দিরা স্নেহমাখা ধমকের সুরে কথা বলেন, ছেলে সুশান্ত আর মেয়ে অনীতা সোজাসুজি ধমকায়, বলে, আর তোমার কথামতো কোনো কিছু চলবে না জেনে রাখো। আর খুব ঘনিষ্ঠরা খবর নিতে এলে ছেলেমেয়ে তাদের কাছে নালিশ জানায়, এই এই অনিয়ম করা হচ্ছিল বা হতে যাচ্ছিল। শুনে তারাও শুভার্থীর মতো হিতোপদেশ দিয়ে যায়।
ডাক্তারদের সিদ্ধান্ত মাইলড করোনারি অ্যাটাক। কিন্তু স্ত্রী ছেলেমেয়েদের দুশ্চিন্তার কারণে আর প্রচারণে রোগীর অবস্থা সকলের কাছেই সংকটজনক হয়ে উঠেছিল। রেডিও থেকে ফোনে বাড়ির লোকের মুখেই খবর নেওয়া হয়েছে। তারা জেনেছে। অবস্থা সংকটজনক–এবং সেই প্রচারই করেছে। খবরের কাজগুলোতেও একইভাবে এই সংকটজনক অবস্থার খবরই ছড়িয়েছে। ছেলের সঙ্গে কথা বলে কোনো কোনো কাগজের প্রতিনিধি এও লিখেছে, মনস্তাত্ত্বিক চবিত্রচিত্রনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী লেখক প্রশান্ত মিত্রর নিষেধেই তাকে হাসপাতালে বা নার্সিংহোমে সরানো সম্ভব হয়নি। শেষের সময় যদি উপস্থিত হয়েই থাকে, তিনি স্বগৃহেই তার জন্য প্রস্তুত। পরে অপ্রত হেলে অবশ্য সরোষে মাথা ঝাঁকিয়ে প্রতিবাদ করেছে, কাগজগুলো মিথ্যেবাদী, আমি কখনো এরকম কথা বলিনি।