এদের মধ্যে একটি বয় সকলের দৃষ্টি কেড়েছিল। বছর তের-চৌদ্দ বয়েস। ফুটফুটে গায়ের রং-ভারী মিষ্টি চেহারা। একমাথা কোঁকড়া চুল। ডাগর চোখ। ছেলেটা যেন সারাক্ষণ উৎসাহ আর উদ্দীপনায় ফুটছে। খদ্দের দেখলেই ছুটে যাচ্ছে, ছাপা মেনু কার্ড সামনে রেখে যাচ্ছে। খদ্দের জিজ্ঞাসা করলে কোন ড্রিংক-এর কি বৈশিষ্ট্য গড় গড় করে বলে যাচ্ছে। প্রথম দিন কি নেবে সুমুরা ঠিক করে উঠতে পারছিল না বলে ছেলেটা মিষ্টি গলায় সুমিত্রাকে বলল, চকোলেট দেওয়া ক্রিম মিল্ক শেক সিন ম্যাডাম, আমি বলছি ভালো লাগবে!
চার্ট দেখে সুমিত্রা জিজ্ঞাসা করলেন, প্লেন পাইনঅ্যাপেল মিলক শেক-এর থেকে দাম বেশী কেন?
সোৎসাহে ছেলেটা বোঝালো কেন দাম বেশী। একটা ইলেকট্রিকে তৈরী হয়, অন্যটা হাতের কাজ। এতে রিস্ক বেশী, মেহনত বেশী। গড় গড় করে আরো কত কি বলে গেল ঠিক নেই।
সমস্ত রেস্তোরাঁয় ওই একটা ছেলে যেন ফুলের মতো মিষ্টি সৌরভ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সকলে তাকে ডাকে, সকলে তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। ফলে ছেলেটার ছোটাছুটির বিরাম নেই। অমন সুন্দর ছেলেটা যেন এই কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছে।
সুমুর মামী আবার একটু-আধটু গল্প-টল্প লেখেন। তার ধারণা, বড় দুঃখের জীবন নিশ্চয় ছেলেটার। ভদ্রঘরের ছেলে যে তাতেও সন্দেহ নেই। অভাবের দায়ে হয়তো অসুস্থ বাপ-মা এই বয়সের এমন ছেলেকে এমন কাজে ঠেলে দিয়েছে।
সেদিন রাত সাড়ে দশটায় সুমুরা সকলে মিলে সেই ঠাণ্ডীঘরে গেছল।
খদ্দেরের ভীড় তখন বেশ হালকা। এবারে দোকান বন্ধ হবার কথা। তাদের। দেখে সেই ছেলেটা ছুটে এল। এই কদিন তার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছে। কিন্তু গল্প করার সময় ছেলেটা পায় না, ছেলেটা তখন দস্তুরমতো ক্লান্ত, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম– তবু হাসি মুখ।
তাকে দেখে সুমিত্রার বাবা মা দাদা বৌদি সকলের মায়া হল। আর রাগ হল। দোকানের মালিক ওই শেঠজীর ওপর। দোকান বন্ধের আগে গদিতে বসে তখন কাড়ি কাড়ি টাকা গুনছে। এদের রক্ত-জল-করা পরিশ্রমের ষোল আনা ওই লোকটাই শুষে নিচ্ছে। এরা হয়তো দুবেলা ভালো করে খেতেও পায় না, আর ওই নিষ্ঠুর মালিক মারসিদিস হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছে!
ছেলেটার নাম শঙ্কর। সেই রাতে সুমিত্রা তাকে এক গেলাস কোল্ড ড্রিংক খাওয়াতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু ছেলেটা একবার দূরের মালিকের দিকে চেয়ে হাসিমুখেই মাথা নাড়ল। অর্থাৎ এখন খাবে না। পাছে ছেলেটার কাজের ক্ষতি হয়, সেজন্য কেউ আর তাকে পীড়াপীড়ি করল না। কাজের ক্ষতি হলেই তো ওই অকরুণ মালিকের কাছে। বকনি খাবে। সুমিত্রা জিজ্ঞাসা করলেন, আজও তুমি সেই বিকেল সাড়ে পাঁচটায় এসেছ?
–না, আমি পাঁচটায় আসি। আধ ঘন্টা আগে এসে সব দেখেশুনে নিতে হয়।
সুমিত্রা জিজ্ঞাসা করলেন, সকাল থেকে পাঁচটা পর্যন্ত কি করো?
সকালে বাড়িতে পড়ি, তারপর স্কুলে যাই- তারপর বিকেলে খেয়েদেয়ে। দোকানে আসি।
–রোজ?
–রোজ।
সুমিত্রার বউদি জিজ্ঞাসা করলেন, বাড়িতে তোমার কে আছেন?
–সবাই আছে।
–বাবা-মা?
ছেলেটা মাথা নাড়ল। অর্থাৎ আছে। তারপর মিষ্টি হেসে বলল, আমার ভাইবোন দুটো ছোট তো, তাই মা আর দোকানে আসতে পারে না। তারপর সকলকে হতবাক করে দিয়ে অদূরে গদিতে বসা দোকানের মালিক শেঠজীকে দেখিয়ে বলল, ওই তো আমার বাবা, দোকান বন্ধ হলে বাবার সঙ্গেই আমি বাড়ি ফিরি। তারপর লজ্জা-লজ্জা মুখ করে বলল, বাবা বুড়ো হেয়ে গেলে আমাকেই তো এত বড় দোকানখানা চালাতে হবে, তাই রোজ বিকেলে বাবা আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে আর সেই রাতে একেবারে দোকান বন্ধ করে একসঙ্গে বাড়ি যাই।…আমার খুব ভালো লাগে। আর বাবা যখন নিজে কড়া খদ্দের সেজে টেবিলে বসে আমাকে সার্ব করতে বলে আর গম্ভার মুখে মিথ্যে মিথ্যে দোষ বার করতে থাকে, তখন কি মজা লাগে না! আমার কিন্তু তখনো হাসার উপায় নেই, সত্যিকারের খদ্দেরের মতোই তাকে বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করতে হয়।
সুমুর শেষ কথায় সম্বিত ফিরল যেন রমেনবাবুর। সুম বলছে, ছেলেটার সেই মিষ্টি মিষ্টি হাসি দেখে আর মিষ্টি কথা শুনে মায়ের মুখখানা যা হয়ে গেল না–তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না বাবা!
তারপর বাড়ি এসেই আমার ওপর ওই হুকুম। শুনে দাদু আর দিদা রাগ করলে, কিন্তু মা আর কোন কথায় কানও দিল না। তারপর আজ হাওড়া স্টেশানে পা দিয়েই আমাকে নিয়ে সোজা এখানে চলে এলো।
সুমিত্রা ঘরে ঢুকতেই ছেলে আর বাবা সচকিত। মায়ের সঙ্গে চোখাচোখি হতে সুমু যেন ধরাই পড়ে গেল। লজ্জা পেয়ে তক্ষুনি প্রস্থান করল।
রমেনবাবু সুমিত্রার দিকে চেয়ে আছেন। সুমিত্রা তার দিকে। …বাইশ বছর বাদে দুজনে দুজনকে নতুন করে দেখছেন।
মুখোমুখি
প্রশান্ত মিত্র দোতলার বারান্দায় ইজিচেয়ারে গা ছেড়ে বসেছিলেন। ঘণ্টাখানেক আগে ইন্দিরা নিজে ওই চেয়ার পেতে তাকে ধরে ধরে এনে বসিয়ে দিয়ে গেছেন। এখানে বসে ইচ্ছে করলে রাস্তার লোক-চলাচল দেখা যায়। ইচ্ছে করলে সামনের আকাশের খানিকটা দেখা যায়। ইচ্ছে করলে রাস্তার উল্টোদিকের বাড়ি কটার জানলা দরজা বা বারান্দার মুখগুলো দেখা যায়। আর কিছুই হচ্ছে না করলে ইজিচেয়ারে মাথা রেখে চোখ বুজে চুপচাপ শুয়ে থাকা যায়।
বেরুবার আগে ইন্দিরা এই শেষের নির্দেশই দিয়ে গেছেন। কিছু চিন্তা করবে না, কিছু ভাববে না, মনটাকে একেবারে ফাঁকা করে দিয়ে চুপচাপ চোখ বুজে শুয়ে থাকবে, আমি এক ঘণ্টার মধ্যে মার্কেটিং সেরে ফিরে আসছি–ঘরে কি আছে আর কি নেই কদিনের মধ্যে তো আর হুশ ছিল না–ছেলেমেয়ে দুটোরও যাদি বিবেচনা বলে কিছু থাকত-বাবার জন্যে কেবল চিন্তা করতেই ওস্তাদ তারা, ফাঁক পেলেই ছুটছাট বেরিয়ে পড়েছে–নিজে না বেরিয়ে করি কি! মহেশ কাছেই থাকবে, কিছু দরকার হলে ওকে বলো, আর খবরদার টেলিফোন এলে তুমি চেয়ার হেড়ে নড়বে না–মহেশ ধরবে, কেউ খোঁজ নিলে কি বলতে হবে ওর এতদিনে মুখস্থ হয়ে গেছে। ঠিক আছে?