বাবা আর ভাইয়ের পরামর্শে সুমিত্রা এরপর ছেলেকে বি. এসসি অনার্স পড়ালো। উদ্দেশ্য, এতেও ভাল ফল হলে ডাক্তার অথবা এঞ্জিনিয়ার কিছু একটা হওয়া সম্ভব। অনেক টাকা মাইনে গুনে গোড়া থেকে দুজন প্রোফেসার রাখা হল। পড়াশোনার ব্যাপারে সুমিত্রা এবার ছেলের ওপরেও নির্মম। কিন্তু বি. এসসির ফল বেরুতে এবারেও সুমিত্রার মাথায় বজ্রাঘাত। ছেলে অনার্সই পায় নি, পাস কোর্সে পাস করেছে।
পাঁচ মাস আগের সেই মর্মান্তিক ব্যাপারটা ঘটে গেল এই নিয়ে। দোষের মধ্যে হেসে হেসে রমেনবাবু বলেছিলেন, অনেক তো দেখলে, এবারে ছেলেটাকে রেহাই দিয়ে আমার হাতে ছেড়ে দাও। আমার সঙ্গে বেরোক, কাজকর্ম শিখুক–ভালোই করবে।
শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন সুমিত্রা।–ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ তোমাকে মাথা ঘামাতে বলেনি, তুমি কুলিমজুর ঠেঙাচ্ছো ঠেঙাও
রমেনবাবুও সশ্লেষে বলে উঠেছেন, আমাকেও তুমি একটু বড়গোছের কুলিমজুরই ভাবো জানি-আর-ঠিকই জানো, আমার ছেলে ওই কুলিমজুরের কাজটাই ভালো পারবে। আর তাতে লজ্জারও কিছু নেই, সেটা মগজে একটু বুদ্ধি থাকলে এত দিনে বুঝতে। তোমার বাবা আর দাদা শুনলাম এবারে সুমুকে চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্সি পড়াতে বলেছে আর তুমিও তাই শুনে নাচছ–কিন্তু আমার কাছে শুনে রাখো তাতে ভস্মে ঘি ঢালা হবে–আর কিছু হবে না।
সুমিত্রার খরখরে দুচোখ তার মুখের ওপর স্থির খানিকক্ষণ।–অভদের মতো চেঁচিও না, সুমুর ব্যাপারে কেউ তোমার পরামর্শ চায়নি!
রমেনবাবু আরো উগ্র।–কেন কেউ চায় নি? কেন তুমি চাও নি?
-তোমার সে যোগ্যতা আছে ভাবি না।
–সেটা ভাবতে হলে নিজেরও কিছু যোগ্যতা থাকার দরকার। ভাববে কি করে, রক্ত-জল-করা টাকা মুঠো মুঠো খরচা করতে পেলে তোমার মতো কালচারের ছটা সকলেই দেখাতে পারে–বুঝলে?
রাগে মুখ সাদা সুমিত্রার।–আবার বলছি, ছোটলোকের মতো চেঁচিও না। এই কালচারের পিছনেই হাতজোড় করে ছুটেছিলে একদিন
ছোটলোক শুনে মাথায় রক্ত উঠল রমেনবাবুর।–আমি সত্যিকারের গাধা বলেই এমন ভুল করেছিলাম, এখন সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি!
খাটের বাজু ধরে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলেন সুমিত্রা। এখন সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছ?
–স্বামীকে ছোটলোক বলার পরেও বুঝতে পারা উচিত নয় ভাবছ?
–ঠিক আছে। বুঝতে যখন পেরেছ, আমার ব্যবস্থা আমি এখনো করব ছেলে সি. এ. পড়বে কি পড়বে না!
পড়বে না, পড়বে না। রমেনবাবু এতকালের সব আক্রোশ উজাড় করে দিতে চাইলেন।-আমার মতো ছোটলোকের ছেলে আমার মতোই ছোটলোক হবে। তোমার বাবা-মাকে গিয়ে বলো, তাদের ঘরের নাতি-নাতনীকে এক-একখানা করে হীরে-জহরত বানাতে–আমার ছেলের দিকে তাকাতে হবে না।
সুমিত্রা শেষবারের মতোই যেন দেখে নিলেন তাকে। তারপর বললেন, তোমার ছেলেও আর তাহলে তোমার ছেলে থাকবে না।
ছেলেকে নিয়ে সুমিত্রা বাপেরবাড়ি চলে গেলেন। সুমুর যাবার ইচ্ছে থাকুক আর না থাকুক, মার অবাধ্য হবার সাহস নেই। এবারে যাওয়াটা অন্যান্য বারের যাওয়ার মতো নয় রমেনবাবু সেটা অনুভব করেও চুপ একেবারে। তার গোঁ চেপে গেছে। শশুরের প্রথম চিঠি পেয়ে আরও তেঁতে উঠেছিলেন। মেয়ের কাছে তাকে মাপ চাইতে বলা হয়েছে! দ্বিতীয় চিঠিতে ডিভোর্সের হুমকি– সে চিঠির জবাব রমেনবাবু দিয়েছেন। আর তারপর থেকে শেষ ফয়েসলার জন্যেই প্রস্তুত হতে চেষ্টা করছেন।
কিন্তু বুকের ভিতরটা খালি-খালি লাগে। তার ফলে নরম হবার বদলে নিজের ওপরেই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন তিনি।
পাঁচ মাস বাদে এই সকালে আচমকা পট পরিবর্তন। ছেলেকে নিয়ে সুমিত্রা নিজে থেকে ফিরে এসেছেন। শুধু তাই নয়, ছেলের প্রতি মায়ের নির্দেশ, এবার থেকে সে বাপের সঙ্গে বেরোবে, তার কাছে কাজ শিখবে।
.
রঘুর সঙ্গে সুমিত্রাও রান্নায় হাত লাগিয়েছেন আজ। সেই ফাঁকে সুমুকে আবার কাছে ডাকলেন রমেনবাবু। চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার রে, তোর মায়ের হঠাৎ এরকম মত বদলালো কেন?
শুনে ছেলে প্রথমে হাসতে লাগল। তারপর বলল, মা আমাকে কিছু বলেন। নি, কিন্তু আমি জানি কেন বদলালো।
–কেন? রমেনবাবু আরো উদগ্রীব।
চাপা আনন্দে সুমু এবারে যে চিত্রটি তার সামনে তুলে ধরল, রমেনবাবুর মুখে আর কথা সরে না। দুকান ভরে শোনার মতোই বটে।
…মায়ের মেজাজ খারাপ, সুমুর দাদু তাই সক্কলকে নিয়ে মাদ্রাজে বেড়াতে গেছলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে ধীরেসুস্থে ডিভোর্সের মামলার ব্যবস্থা করার কথা। সুমুর মামাও দাদুর দিকে।
…মাদ্রাজে মস্ত সফট ড্রিংক-এর রেস্তোরাঁ আছে। সকলে সেটাকে শেঠজীর ঠাণ্ডা ঘর বলে। বিরাট ব্যাপার। বড় বড় লোকেরা গাড়ি হাঁকিয়ে আসে সেখানে। বিকেল পাঁচটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত জমজমাট ব্যাপার। দিশী বিলিতি যাবতীয় কোল্ড ড্রিংক এর বিশাল এয়ারকনডিশন রেস্তোরাঁ। কত বেয়ারা আর বয় খাটছে ঠিক নেই।
সুমুরা দল বেঁধে সেই কোল্ড ড্রিংক-এর রেস্তোরাঁয় তিন-চার দিন গেছে। ঠাণ্ডী ঘরের মালিক আধবয়েসী শেঠজীকে মারসিদিস গাড়ি থেকে নামতে দেখেছে। কিন্তু সুমুরা তার ওপর মনে মনে খুশী নয় তেমন। গদিতে বসে শ্যেনদৃষ্টি মেলে সকলের কাজের তৎপরতা দেখেন, খদ্দেরকে খুশী করার ব্যাপারে বয় বা বেয়ারাদের এতটুকু ক্রটি দেখলে তাকে কাছে ডেকে চাপাগলায় বেশ করে ধমকে দেন।