সেই বিকেলেই লোকটার দেখা পেলেন। তার খানিক আগেই বাবা বেরিয়েছেন। দূর থেকে তাকে দেখে সুমিত্রা ভুরু কোচকালেন। তারপর হনহন করে সামনে এসে দাঁড়ালেন– কাকে দরকার? বাবাকে না আমাকে?
-উনি তো একটু আগে বেরিয়ে গেলেন দেখলাম। আমতা-আমতা জবাব।
ঘুরিয়ে বলা হল তাকেই দরকার।
সুমিত্রার গলার স্বর এবারে ঝাঝালো।–চিঠির জবাব চাই?
–পেলে নিশ্চিন্ত হতাম।
-তাহলে একটু অপেক্ষা করতে হবে। বাবা ফিরলে চিঠি তার হাতে যাবে। তিনিই জবাব দেবেন।
রমেন চৌধুরী চুপচাপ মুখের দিকে চেয়ে রইলেন কয়েক পলক। ভীত চাউনি নয়– বিমর্ষ বললেন, তাতে আর লাভ কি! চিঠি পড়ে তিনি গলাধাক্কা দেবেন, আর তুমি না চাইলে আমি বরাবরকার মতো চলে যাবো। তোমার কাছ থেকে এটুকু সম্মান অন্তত দুষ্প্রাপ্য ভাবি নি।
-তুমি! তোমার! সত্যিকারের ঝলসেই উঠেছিলেন সুমিত্রা।
বিব্রত মুখে রমেন চৌধুরী বলেছিলেন, খুব অন্যায় হয়েছে।… নিজের মনে তুমি তুমি করে চার বছর এত কথা বলেছি যে ওটা আপনিই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
এ কথা শুনে ওই মুখ দেখে কেন যেন সুমিত্রা সেরকম জোরের সঙ্গে রাগ। করে উঠতে পারেন নি। তবু তার গলায় ব্যঙ্গ ঝরেছে। নিজেও তুমি করেই বলেছেন।–তাহলে তুমি আশা করছ, জবাবটা আমিই দিয়ে তোমাকে একটু সম্মানিত করব!
-হ্যাঁ।
–আর জবাব পেলে তুমি নিজে থেকেই বাবাকে ছেড়ে চলে যাবে!
–তা না গেলে নিজের আত্মসম্মানে লাগবে।
–আর সেই জবাবটা যদি অত হৃদয়বিদারক না হয়, তাহলে বাবার অনুগ্রহে থেকে আমার যোগ্য হতে চেষ্টা করবে! সুমিত্রার গলার স্বর একটুও নরম নয়।
-তার অনুগ্রহ ছাড়াই চেষ্টা করব। রমেন চৌধুরীর শান্ত জবাব।
সুমিত্রার এবারে একটু মজাই লাগল।–বেশ, বাবার অনুগ্রহ ছাড়া যোগ্য হতে পারলে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তাতে কত বছর লাগবে?
-ভরসা পেলে দুবছরের বেশী লাগবে বলে মনে হয় না।…আমার বাবার একটা জমি কেনাই ছিল, দুবছরের মধ্যে সেখানে তোমার পছন্দমতো একটা বাড়ি তুলতে পারলে যোগ্যতার পরীক্ষায় তোমার যদি পাস-নম্বর দিতে আপত্তি না হয়, তাহলে গড়গড় করে আরো বড় পরীক্ষায় উতরে যাওয়া কঠিন হবে না।
প্রস্তাবে বৈচিত্র্য ছিল। মানুষটার জোরের দিক যাচাই করার লোভও হয়েছিল। সুমিত্রা কথা দিয়েছিলেন, দুবছর অপেক্ষা করবেন।
…শ্বশুরবাড়ির আদবকায়দার সঙ্গে কোনদিনও নিজেকে মেলানো সম্ভব হয়নি রমেন চৌধুরীর। এই রকম অসম বিয়েতে সুমিত্রার বাবা-মায়ের এবং বিলেত-ফেরৎ এঞ্জিনিয়র দাদার একটুও সায় ছিল না। কিন্তু আদবকায়দা ভুলে কালচারড মেয়ের সিদ্ধান্তও সরাসরি কেউ বাতিল করে দেননি। সুমিত্রা বিজয়ীর গলায় মালা যেমন দিয়েছিলেন, সেই সঙ্গে বাপের বাড়ির আভিজাত্যের ছটাও তেমনি পুরেপুরি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। এদিক থেকে স্বামীটিকে উপযুক্ত করে তোলা যেন একটা বড় দায়িত্ব তার। গোড়ায় গোড়ায় মজাই পেতেন রমেনবাবু। পরে সন্তর্পণে শ্বশুরবাড়ির সংস্রব এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করতেন। নিরলস প্রবল কর্মী পুরুষ তিনি, কিন্তু শ্বশুরবাড়ির অন্য সকলের কথা বাদ দিয়ে সুমিত্রারও এজন্যে তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা আছে মনে হত না। সুমিত্রার যা কিছু পরামর্শ সব তার বাবা মা দাদার সঙ্গে।
রমেনবাবু সহজে কিছু বলতেন না! আর যদি কখনো কিছু বলেন, সুমিত্রা সঙ্গে সঙ্গে টেনে ধরতেন–তুমি যা বোঝ না তা নিয়ে মাথা ঘামিও না।
এই থেকেই বিরোধের সূচনা ক্রমশ। বছর না ঘুরতেই কোলে ছেলে এলো, সুমিত্রার চোখে এও যেন মেহনতী মানুষের বিবেচনার অভাব। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আর ছেলেপুলে নয়। এই লোকের প্রতি নির্ভর করতে না পেরে নিজেই তিনি সাবধান হয়েছেন। আর এই এক ছেলে সুমুও বড় হতে থাকল তাঁর মায়ের আর মামা-বাড়ির হেপাজতে থেকে। এ ব্যাপারেও রমেনবাবুর বক্তব্য বা বিবেচনা কেউ গায়ে মাখেন না।
কিন্তু ওপরওয়ালা শোধ নিচ্ছেন। ছেলেটা বাপের নেওটা, বাপের কাছে আসতে পেলে মা বা মামারবাড়ির দিকে ঘেঁষতে চায় না। দু-দুটো মাস্টার রাখা সত্ত্বেও স্কুলের পরীক্ষায় কোনদিন প্রথম দশজনের মধ্যেও তার নাম দেখা যায় না। মা শাসন করতে গেলে ছেলে বাপের কাছে পালায়। ওকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বেড়েই চলে। বাপ ছুটির দিনে বাগানের কাজে হাত দিলে ছেলে সোৎসাহে কোদাল দিয়ে মাটি কোপায়, জলনিকাশের নালা তৈরি করে। আর তাই দেখে মায়ের হাড়পিত্তি জ্বলে। সুমিত্রার মনের তলায় সব থেকে বড় আশঙ্কা, ছেলেটা বাপের মতো হয়ে। উঠছে। এই আশঙ্কা চাপাও থাকে না সব সময়। তখন স্বামী-স্ত্রীতে তুমুল ঝগড়া অনিবার্য।
এঞ্জিনিয়র দাদুর ইচ্ছে ছিল নাতি মস্ত ডাক্তার হোক। আর এঞ্জিনিয়র মামার ইচ্ছে ভাগনে বড় এঞ্জিনিয়রই হোক। কিন্তু দুদুটো বাছাই করা মাস্টার রাখা সত্ত্বেও সুমু সকলের আশায় ছাই দিয়ে হায়ারসেকেণ্ডারিতে সেকেণ্ড ডিভিসনে পাস করে বসল। এর ফলে সুমিত্রার যত রাগ গিয়ে পড়ল ছেলের বাপের ওপর। আর বাপ বলল যা হয়েছে হয়েছে, কত ছেলে তো থার্ড ডিভিসনে পাশ করে!
এই নিয়ে শেষে তুমুল বির্তক আর তারপর সুমিত্রার রাগ করে বাপেরবাড়ি প্রস্থান। ইদানীং এই রাগারাগি আর প্রস্থান একটু ঘন-ঘনই হচ্ছিল।