শুনে রমেনবাবুই হাঁসফাস করে উঠলেন। সুমিত্রা ফিরেই যখন এসেছে এ প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি আর ঘোঁট পাকাতে চান না। তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললেন, না-না, ও তুমি যা চাও তাই হবে। সুমু চার্টার্ড অ্যাকাউনটেনসিই পড়ক, দেখেশুনে ভালো একটা ফার্মে ভর্তি হয়ে যাক, তারপর টাকা খরচ করলে গাইড করার লোকও ঠিকই পাওয়া। যাবে।
সুমিত্রার চোখদুটো এমনিতেই বড়। মুখের দিকে স্থির তাকিয়ে থাকলে আরো বড় দেখায়। তেমনি চেয়ে রইলেন কয়েক পলক। বললেন, কিন্তু আমি এখন আর তা চাই না–যা চাই তাই তোমাকে বললাম। কাল থেকেই ও তোমার সঙ্গে কাজে বেরুবে।
উঠে চলে গেলেন। রমেনবাবুর ভ্যাবাচাকা খাওয়া মুখ। না, সুমিত্রার এ-রকম পরিবর্তনের জন্য তিনি কোনো ঠাকুর-দেবতার দোরে ধর্ণা দেননি। তবু এ কি করে সম্ভব হল ভেবে পাচ্ছেন না। সুমিত্রা যে রাগ করে নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছে বাতিল করে এ-ভাবে ফিরে এসে আত্মসমর্পণ করল, রমেনবাবুর সেরকমও মনে হচ্ছে না। তার নিজের ইচ্ছেটাই সব। সে কোনরকম আপোসের ধার ধারে না।
অথচ এই সুমু আর সুমুর ভবিষ্যৎ নিয়েই পাঁচ মাস আগের সেই চরম ব্যাপার। অবশ্য এর আগেও স্বামী-স্ত্রীতে অনেক ঝগড়া হয়েছে আর সুমিত্রা রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেছে। ঝগড়া বলতে যে গোছের বাকবিতণ্ডা বা বচসা বোঝায় তা নয়। সেভাবে কথা-কাটাকাটি করতে সুমিত্রার রুচিতে বাধে। আর রমেনবাবুও সবসময় কটকট করার মানুষ নন। যতক্ষণ সম্ভব সহ্য করেন, আর চুপচাপ দেখে যান বা শুনে যান। তারপর নিতান্ত অসহ্য হলে দুমদাম দু-পাঁচ কথা বলে বসেন। সুমিত্রা তখন এমনভাবে চেয়ে থাকেন যে তার সামনে কোনো ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে না ইতরজন– তাই যেন সন্দেহ। তাই দেখে রমেনবাবুর মেজাজ এক-এক সময় দ্বিগুণ বিগড়োতো। তখন মাত্রাজ্ঞান ছাড়িয়েই যেত। ওরকম অশালীনতার একটাই জবাব, সুমিত্রার বাপের বাড়ি প্রস্থান। এরপর রমেনবাবু প্রথমে ছেলেকে পাঠাতেন, তারপরে টেলিফোনে। যোগাযোগের চেষ্টা করতেন। শেষে মুখ কাচুমাচু করে নিজেই শ্বশুরবাড়ির দিকে পা বাড়াতেন।
শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সর্বদাই তাঁদের মেয়ের পক্ষে। শাশুড়ী ঠারেঠোরে কিছু মন্তব্য করেন, শ্বশুর গম্ভীর মুখে দুই-একটা জ্ঞানের কথা শুনিয়েছেন। বড়শালা বা শালার বউও দুই-একটা বিদ্রুপাত্মক কথা শোনাতে ছাড়েন না। তখনও ভিতরে ভিতরে ফুঁসতে থাকেন রমেনবাবু। কিন্তু তখন তার কানে তুলো, পিঠে কুলো। তবু নিজে গেলেই যে সুমিত্রাকে আনা যেত এমন নয়, তবে তাতে কাজ হত। রাগের মাত্রা অনুযায়ী একদিন বা দুদিন বা পাঁচদিন বাদে সুমিত্রা ফিরে আসতেন।
রমেনবাবুর মতো ঠাণ্ডা মানুষের হঠাৎ-হঠাৎ ধৈর্য্যের বাঁধ কেন ভাঙে সুমিত্রা সেটা কখনো বোঝেননি বা বুঝতে চেষ্টা করেননি। তার কারণ রমেন চৌধুরী মানে এক সাধারণ কনট্রাকটারের জীবনে তিনি দয়া করে পদার্পণ করেছেন এবং নিজের মর্যাদা অনুযায়ী সেখানে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করে চলেছেন।
সুমিত্রার বাবা এক মস্ত এঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর এবং চার আনার মালিক। বড় অবস্থা। তেমনি চালচলন। আর রমেনবাবুর বাবা ছিলেন ওভারসিয়ার। নিজের উদ্যমে কনট্রাকটরি ব্যবসা ফেঁদে বসেছিলেন তিনি। বিশ্বস্ত মানুষ। সুমিত্রার বাবা তাকে পছন্দ করতেন। অনেক কাজও দিতেন। বি.এ পাশ করে রমেনবাবু আর চাকরির চেষ্টায় না গিয়ে বাপের ব্যবসায়ে লেগে গেছলেন, আর নিজের সততা আর পরিশ্রমের ফলে অল্পদিনের মধ্যে তিনিও সুমিত্রার বাবার সুনজরে এসে গেছলেন। বছর দুই-আড়াইয়ের মধ্যে রমেনবাবুর বাবা মারা গেলেন। আর সত্যি কথা বলতে কি, সুমিত্রার বাবা তখন ওই উদ্যোগী ছেলেটা অর্থাৎ রনেমবাবুর প্রতি একটু বেশী উদার হয়েছিলেন। কর্মঠ, বুদ্ধিমান ছেলে। কাছে ডেকে তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। কাজও আগের থেকে আরও বেশীই দিয়েছেন ক্রমশ। আর তার ফলাফল দেখে খুশীই হয়েছেন।
–রমেনবাবুর তখন পঁচিশ বছর বয়েস। একটা চাপা প্রলোভন দুর্বার হয়ে উঠল। কাণ্ডজ্ঞান খুইয়ে একেবারে মুখথুবড়ে পড়লেন। অর্থাৎ ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের একমাত্র মেয়ে সুমিত্রাকে একখানা চিঠি লিখে বসলেন। তার চার বছর আগে থেকে এ বাড়িতে আনাগোনা। ওই মেয়েকে অনেকবার দেখেছেন। খুব যে রূপসী তা নয়, সুখের ঘরে ওটুকু রূপ অনেক মেয়েরই থাকে। কিন্তু তাকে দেখে দেখে রমেন চৌধুরীর পাগল হওয়ার দাখিল। সুমিত্রার তখন সবে উনিশ। কলেজে পড়ছেন। তাঁর দাদা বিলেতে। সেখানে তিনি এঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন। ভাবতে গেলে এই লোভ আকাশের চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর সামিল। কোন যুক্তির দিকে না গিয়ে দীর্ঘদিনের একটা যন্ত্রণার অবসান করে দেবার সংকল্পে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
চিঠিতে চার বছরের স্বপ্ন আর সেই দুঃসহ যন্ত্রণার কথাই লিখেছিলেন। আর লিখেছিলেন, যদি এতটুকু আশা পান তাহলে মৃত্যু পণ করেও তিনি সুমিত্রার যোগ্য হয়ে উঠতে চেষ্টা করবেন।
স্বাস্থ্যবান সুঠাম এবং সুশ্রী লোকটাকে চোখের কোণ দিয়ে সুমিত্রাও বহুবারই দেখেছেন। ও-রকম করে দেখা আর নিজেকে যাচাই করারই বয়েস সেটা। কিন্তু ঐ দেখা পর্যন্তই। বাবার আশ্রিতজনের প্রতি এতটুকু দুর্বল চিন্তার প্রশ্রয় ছিল না। তাই চিঠি পেয়ে সুমিত্রা প্রথমে স্তম্ভিত। এ দুঃসাহস ছাড়া আর কি? চিঠিটা বাবাকে দেখিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলার ইচ্ছে। কিন্তু লোকটার মুখখানা মনে পড়তে তখনকার মতো ইচ্ছেটা বাতিল করলেন। কেন যেন একটা গুরুতর শাস্তি মাথায় চাপিয়ে দিতে ইচ্ছে করল না। দরকার হলে ধৃষ্টতার জবাব নিজেই দিতে পারবেন। তাছাড়া বাবাকে যখন খুশী বলা যেতে পারে।