এ-কথা শুনে রমেনবাবুই যেন ফাঁপরে পড়লেন। তাড়াতাড়ি বললেন, না না, ও-সব তোকে করতে হবে না।
সুমিত্রা মোটা চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়াচ্ছিলেন। অনেক চুল। সেই চুলে চিরুনি সুষ্ঠু হাত থেমে গেল। সামান্য মুখ ফিরিয়ে তার দিকে তাকালেন।
রমেনবাবু ছেলেকে বললেন, মা যা বলবেন তাই করবি।
বা রে, মা-ই তো ওই কথা বলেছে তোমার সঙ্গে কাজ করব, তোমার কাছে। কাজ শিখব
রমেনবাবু আবারও হতচকিত একটু। এতো বিশ্বাস করতে হবে!
সুমিত্রার হাতে আবার চিরুনি চলছে। আয়নার দিকে মুখ। ছেলেকে বললেন, রঘুকে ওই চায়ের ট্রে নিয়ে যেতে বল, চা-জলখাবার সব একেবারে নিয়ে আসুক, গল্প করতে হয় মুখ হাত ধোওয়া হলে তারপর কর, সকাল নটা বেজে গেল–
পরোক্ষ শেষের উক্তিটা রমেনবাবুর উদ্দেশ্যে সেটা ছেলেও বুঝল। খাট ছেড়ে মায়ের নির্দেশ পালন করতে চলল সে।
সুমিত্রা ধীরেসুস্থে মাথা আঁচড়াচ্ছেন। অত চুলের জন্য শরীরের ওপরের দিকটা একটু বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে। লোভীর মতোই দেখতে ইচ্ছে করছে রমেনবাবুর। আগে তাই দেখতেন। আয়নার ভিতর দিয়ে সুমিত্রার সঙ্গে আবার চোখাচোখি হতে তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে এলেন। যেন তাড়া আছে এমনি ভাব করে মুখ হাত ধুতে চলে গেলেন।
হঠাৎ কি হল বা হতে পারে মাথায় ঢুকছে না। এই ছেলেকে অর্থাৎ সৌমেনকে নিয়েই মর্মান্তিক বিচ্ছেদ সুমিত্রার সঙ্গে। এবারে কোর্টে নিষ্পত্তি হবার কথা। শ্বশুরের শেষ কড়া চিঠিতে এ-রকম আভাসই পেয়েছিলেন তিনি। আর গোঁ ধরে সেই অবাঞ্ছিত পরিণামের অপেক্ষাতে ছিলেন। তার মধ্যে ছেলে নিয়ে সুমিত্রা হঠাৎ ফিরে আসবে এ তিনি ভাববেন কি করে? শুধু তাই নয়, সুমু বাপের কাছে কাজ শিখবে, বাপের সঙ্গে কাজ করবে–সুমিত্রাই নাকি এ-কথা বলেছে! এ কানে শুনলেও সত্যিই বিশ্বাস করেন কি করে?
তোয়ালেতে মুখ মুছে আবার ঘরে ফিরলেন রমেনবাবু। মাথা আঁচড়ানো শেষ করে সুমিত্রা মনযোগ দিয়ে কপালে সিঁদুরের লাল শিখা দিচ্ছে দেখলেন রমেনবাবু। রঘু চা আর সকালের খাবার রেখে গেছে। আয়নায় আবার চোখাচোখি হতে রমেনবাবু। মুখ ফিরিয়ে পট থেকে পেয়ালায় চা ঢালতে লাগলেন।
-আগে টোস্ট আর পোচ খাও, তারপর চা ঢালবে।
আগে যে মেজাজে কথা বলত সুমিত্রা তার খুব একটা রকমফের হয়, নি। হাব ভাব-আহণও বদলায়নি। তবু এরই মধ্যে কোথায় যেন একটু ভিন্ন স্বাদ পাচ্ছেন। রমেন চেরী। টোস্ট আর ডিমের পোচ টেনে নিলেন। সুমিত্রা সামনে এগিয়ে এলেন। তাঁর দিকে চেয়ে রমেনবাবু হাসতে চেষ্টা করলেন একটু। আজ অনেককাল বাদে টোস্ট আর পোচ থেকে হঠাৎ এই মুখখানা ঢের বেশী লোভনীয় লাগল তার। কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে বেশী তাকাতেও পারছেন না।
-এই পাঁচ মাসে চেহারার তো বেশ উন্নতি হয়েছে দেখছি!
সুতির গলায় একটু শ্লেষের আভাস আছে কি নেই ঠিক ধরতে পারলেন না। সহজ হর চেষ্টায় একটু হাসলেন রমেনবাবু।–কেন, খারাপ দেখছ?
রঘু বলল, সকালে তিন চার পেয়ালা চা ছাড়া আর কিছু খেতে না। রাতেও দুটোর আগে ঘরের আলো নিভত না। শরীর খারাপ হবে না তো কি ভালো হবে?
রঘু ব্যাটা এইভাবে তাঁকে ডুবিয়েছে! কিন্তু চেষ্টা করওে তিনি রঘুর উপর রাগ করতে পারলেন না। পারলেন না, কারণ সুমিত্রার সেই চিরাচরিত কর্তৃত্ব আর ব্যক্তিত্বের ফাটল দিয়ে আজ তিনি ভিন্ন রকমের কিছু দেখতে পাচ্ছেন। জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কেমন ছিলে?
–কেমন ছিলাম পাঁচ মাসের মধ্যে একটা চিঠি লিখে তো খবর নিতে পারতে? না কি ভেবেছিলে, দূর হয়েছে ভালই হয়েছে!
জবাবে রমেন চৌধুরী বলতে পারতেন, তিনি চিঠি লেখার জন্যে প্রস্তুত হবার আগেই শশুর দুদুখানা কড়া চিঠি পেয়েছেন। একটাতে তার উপদেশ ছিল, নিজে এসে মেয়ের কাছে মাপ চেয়ে তাকে যেন ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। মাস দেড়েক প্রতীক্ষার পরে শ্বশুর দ্বিতীয় চিঠিতে লিখেছিলেন, তিনি এবং সুমিত্রা দুজনেই ডিভোর্স সুট ফাইল করার কথা ভাবছেন। আশা করা হচ্ছে, এ নিয়ে সে (অর্থাৎ রমেন চৌধুরী) বেশী তিক্ততা সৃষ্টির চেষ্টা করবে না। এবং সৌমেনের ভবিষ্যতের যথাযথ ব্যবস্থাও তার বাবা বিনা জোরজুলুমেই করবেন।
এই দ্বিতীয় চিঠির জবাব রমেন চৌধুরী শশুরকে দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, সৌমেন সাবালক, সে ইচ্ছে করলে তার বাবার কাছে থাকতে পারে, ইচ্ছে করলে মায়ের কাছে থাকতে পারে। আইনগতভাবে তার প্রতি আর কোন দায়িত্ব রমেনবাবুর নেই। তবে ছেলে যদি তার বাবার কাছে থাকা সাব্যস্ত করে, তার ভবিষ্যৎ-চিন্তাও তিনিই করবেন।
এ সব কথা মনে এলেও আজকের এই অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে তা বলা যায় না। টোস্ট চিবুতে চিবুতে সুমিত্রার মুখের দিকে চেয়ে একটু ঠাট্টাই করলেন রমেনবাবু। বললেন, এ-বয়সে স্ত্রী দূর হয়ে গেলে আর ভালোটা কি হতে পারে?
এইটুকুতেই সেই চিরাচরিত অসহিষ্ণুতা সুমিত্রার, থাক! পয়সার গরম হলে ষাট বছর বয়েসটাকেও তোমারা খুব একটা বয়েস ভাব না-বুঝলে?
রমেন চৌধুরী হাসছেন।–আমার ছেচল্লিশ…এটা কি তাহলে পুরো যৌবন?
সুমিত্রা চোখের কোণে মানুষটাকে আর একবার দেখে নিলেন। সকালে যখন পাখার হাওয়ায় কুঁকড়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছিল তখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন। নিরীহ– ঘুমন্ত মানুষটার দিকে চেয়ে তখনো একটা জোরের দিক আবিষ্কার করছিলেন তিনি। এখনো সেই জোরের দিকটাই দেখছেন। একটুও রাগ হচ্ছে না, বরং ভালো লাগছে। এই ভালো লাগার স্বাদটা আশ্চর্য রকমের নতুন। হঠাৎ হাসলেন সুমিত্রা একটু। বললেন, যাক শোন, সুমু ঠিকই বলেছে- এখন থেকে সে তোমার সঙ্গে কাজে বেরুবে।