মাস্টার সাহেব অর্থাৎ অমর ঘোষ এককথায় রাজি হয়ে গেছল। তার তখন রাতিমতো দৈন্যদশা চলেছে। যত্রতত্র খাওয়া আর যত্রতত্র শোওয়া। আশা করেছিল বরিসকর সাহেবের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে থাকতে পেলে একদিন তার অভিনয়েরও কদর হবে। তা আর হল না। সেই থেকে সে মাস্টার সাহেব। ছোট ভূমিকায় অভিনয়ে নামলেও পর্দায় নাম লেখা থাকে মাস্টার সাহেব। এতদিন নিজের ম নিজেই সে ভুলতে বসেছে, কারণ নাম বললে চেনা মহল বা স্টুডিও মহলের কেউ তাকে চিনবে না।
বয়েস এখন পঞ্চাশের কাছাকাছি। একমাথা কঁচা-পাকা চুল। ফর্সা কোনদিন ছিল না, গায়ের রঙে এখন আরো পোড় খেয়েছে। তবে এখনো সুশ্রী, আর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। নিজের ভাগ্য নিয়ে আর কোন আক্ষেপ নেই। বরং বেশ হাসিমুখে কৌতুকরসে জারিয়ে নিজের দুর্ভাগ্যের গল্প করতে পারে। এখন এক স্টুডিও এলাকাতেই নামমাত্র ভাড়ায়। একখানা ঘর নিয়ে আছে। সেই স্টুডিওর খাতাপত্র দেখার চাকরি করে, মাইনে সর্বসাকুল্যে চারশো। বোম্বাই শহরে এ-টাকায় মাস চালাতে হলে প্রতিটি পয়সার হিসেব রেখে চলতে হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেউ বেজার মুখ দেখে না তার।
এই বয়সেও এত কম মাইনে। তার কারণ আছে। স্টুডিওর এই চাকরি খুব বেশি দিনের নয় তার। মাত্র দেড়-দু বছরের। তাও আগে চেনা-জানা ছিল বলে স্টুডিওর মালিকরা দয়া করে তাকে এই কাজটুকু দিয়েছে। চাপাচাপি করলে মাইনে আরো কিছু বাড়তে পারে, কিন্তু মাস্টার সাহেব তা করে না। দিব্যি চলে যাচ্ছে। নিজে রেধে খায়, আর নেশার মধ্যে শুধু বিড়ির খরচ।
এখানকার চাকরির আগে মোটামুটি ভালভাবেই দিন কেটেছে তার। টানা বারো তেরো বছর অজিত বরিসকরের কাছে বাড়ির লোকের মতোই ছিল। সেই ভদ্রলোকের ছোট ছেলেটাও সেকেণ্ডারি পাশ করে বেরিয়ে যাবার পর মাস্টার সাহেবের ডাক পড়েছে। তার বড় মেয়ের বাড়িতে। বড় মেয়ের নাম শীলা। বিয়ের পর তিড়কে হয়েছে। মাস্টার সাহেব যখন বরিসকর বাড়ির বাসিন্দা, শীলার বয়েস তখন উনিশ-কুড়ি। আরো বছর দেড়েক বাদে দিলাপ তিড়কের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের পৈতৃক ব্যবসা। শীলাদের থেকেও বড় অবস্থা। মেয়ে পছন্দ হতেই তুলে নিয়ে গেছে। পছন্দ হবার মতো মেয়ে তো বটেই। কলেজে পড়ে, চেহারাপত্রের চটক খুব, কালো চোখের শরে পুরুষ ঘায়েল করার কেরামতি রাখে। বিয়ে হবে না কেন! বিয়ের একমাস বাদে দিলীপ তিড়কে লণ্ডন চলে গেছল বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়তে। বছর দুই বাদে ধৈর্য খুইয়ে চলে এসেছে। শালা ততদিনে এক ছেলের মা। বিয়ের নমাসের মধ্যেই তার ছেলে হয়েছে। ছেলের অন্ন প্রাশনের উৎসবে দিলীপ তিড়কে সাত দিনের জন্য এরোপ্লেনে চেপে চলে এসেছিল। ধুমধামের পর আবার ফিরে গেছে।
যাই হোক, দিলীপ তিড়কে ফিরে আসার দশ-বারো বছরের মধ্যে শীলার আরো দুটি মেয়ে আর একটি ছেলে হয়েছে। তার বছর কয়েকের মধ্যে শীলার ছোটভাইয়ের পড়া সাঙ্গ হতে বাপের কাছে আব্দার জানিয়ে মাস্টার সাহেবকে নিজের বাড়িতে এনে তুলেছে। আর ছেলেমেয়েদের পড়ানোর ভার তার হাতে ছেড়ে দিয়েছে। শিক্ষক হিসেবে মাস্টার সাহেবের গুণ কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কারণ শীলার তিন তিনটি সাদা-মাটা ভাই-ই দিব্যি ভালো রেজাল্ট করে বেরিয়ে এসেছে।
তিড়কের বাড়ি এসে মাস্টার সাহেবের দিন আরো ভালো কেটেছে। বাড়ির কর্তা। অর্থাৎ শীলা কে সন্ত্ৰমের চোখে দেখে, অন্যেরাও তাকে কিছুটা সমীহ করে চলবে বইকি। তার ওপর দিলীপ তিড়কে কিছুটা নির্বিলিক মানুষ। তারও গো আছে বটে, কিন্তু না ঘটালে সে কারো সাতে-পাঁচে নেই। মাস্টার সাহেবের মাইনে সর্বসাকুল্যে তখন সাড়ে সাতশো টাকা। শীলা দেয় সাড়ে চারশো, আর স্টুডিওর কাজের জন্য তার বাপ নেয় তিনশো। প্রায় সবটাই ব্যাঙ্কে জমা পড়ার কথা। খাওয়া-পরার খরচ এক পয়সা নেই। কিন্তু দুদুটো বড়লোকের বাড়িতে থাকার ফলে মাস্টার সাহেবের। একটু খারাপ অভ্যেস হয়ে গেছল। মদ খাওয়া ধরেছিল। এ-জিনিসটা দুবাড়িতেই জল-ভাত ব্যাপার। আর সিগারেট খরচাও ছিল তখন। তখন তো আর বিড়ি ফুকত না। বছর দুই আগে বলা নেই, কওয়া নেই, বাড়ির মেজাজা কত্রী শীলা তিড়কে হুট করে তাকে বিদায় করে দিতে বেশ ফাঁপরে পড়েছিল মাস্টার সাহেব। এ-রকম হবে। বা হতে পারে ভাবেনি, কারণ তখনো তার ছোট ছেলের স্কুলের পড়া শেষ হতেই বেশ বাকি। আবার ততদিনে মাস্টার সাহেবের সিনেমার চাকরিও গেছে। শীলার বাবা চোখ বোজার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সে ব্যবসায় যবনিকা পড়েছে। বাবার দেওয়া মাইনেটাও শীলা পুষিয়ে দিচ্ছিল। মেয়েটার, এখন আর মেয়েটার নয়, মহিলাটির এমনিতে দরাজ মন, কিন্তু তার মেজাজ বোঝা ভার। মাস্টার সাহেবও কোনরকম আবেদন না জানিয়ে চলেই এসেছে। তারপর এই স্টুডিওর চাকরিটুকু জোটাতে পেরে নিশ্চিন্ত।
মাস্টার সাহেবের সঙ্গে এই স্টুডিওতেই গেল বছরে আলাপ আমার। নিজের গল্পের একটা ছবির কাজেই কিছুদিন ছিলাম। লোকটিকে আমার ভালো লেগেছিল। আমার অঢেল সময়। তার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছে। ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে সে তার হাতের রান্নাও খাইয়েছে আমাকে। তখনই নিজের জীবনের গল্প করেছে।
এবারেও ছবির কাজে আসা। আমাকে দেখে মাস্টার সাহেব ভারা খুশি। তার সঙ্গে থাকার আমন্ত্রণ পর্যন্ত জানিয়েছিল। বলেছিল, আপনার মতো একজনের সঙ্গে আমার খাতির দেখলে এরাও আমাকে একটু অন্য চোখে দেখবে। সেটা সম্ভব হয়নি, কিন্তু আড্ডা দিতে তার ঘরে প্রায়ই গেছি।