পরদিন সকালে বেশ হাসি-হাসি মুখে ইন্দিরা ঘরে ঢুকলেন। তার হাতে একখানা এই বাংলা মাসিকপত্র। কাছে এসে ওটা খুলে প্রশান্তবাবুর সামনে ধরলেন। তাতে ছবিসহ অনন্য লেখক প্রশান্ত মিত্রর দ্রুত আরোগ্য-সংবাদ। ফাঁকে ফাঁকে তার প্রতিভার প্রশস্তি! বিশেষ করে তার চরিত্রচিত্রণ আর বিশ্লেষণ ক্ষমতার ঢালাও প্রশংসা।
হাসিমুখে এই বাংলা ইন্দিরাকে ফেরত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশান্তবাবুর কি মনে হল। চট করে উঠে কালো নোটবই আর কলমটা নিয়ে পাশের লেখার ঘরে। চলে গেলেন। এতে কিছু লিখে আবার চার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে এলেন।
ইন্দিরা অবাক একটু।–কি হল, এই থেকেই আবার নতুন কিছু প্লট মাথায় এসে গেল নাকি!
প্রশান্ত মিত্রর ঠোঁটের হাসিটুকু রহস্যের মতো। নোটবই যথাস্থানে অর্থাৎ ডেকে রাখতে রাখতে জবাব দিলেন, ওই তেলের প্লট নিয়ে গপপ তো কত বারই লেখা হয়ে গেছে!
.
দিন কুড়ি বাদে নীল আকাশ থেকে আচমকা বাজ পড়ার মতোই ঘটে গেল– ব্যাপারটা। লেখক প্রশান্ত মিত্র চিকিৎসার চার ঘণ্টা সময় দিলেন না। ডাক্তাররা বললেন, ম্যাসিভ স্ট্রোক। বাংলা সাহিত্য জগতে নিখাদ শোকের ছায়া নেমে এলো। প্রশান্ত মিত্র নেই।
দিন যায়। একটা মাস গড়ালো। শোকের স্তব্ধতা থেকে ইন্দিরাকেও আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াতে হল। এই নিয়ম।
কদিন ধরে টেলিভিশনের লোক এসে এসে ঘুরে যাচ্ছে। তাদের প্রস্তাব, প্রয়াত অনন্য লেখকের সাহিত্যজীবন আর ঘরের জীবন নিয়ে স্বয়ং ইন্দিরা মিত্র একটা প্রোগ্রাম করুন। এই প্রোগ্রাম শত সহস্র দর্শক শ্রোতার কাছে পরম সমাদরের জিনিস হবে।
কিন্তু গোড়ায় গোড়ায় ইন্দিরা টিভির লোকের সঙ্গে দেখাই করেন নি। ছেলেমেয়ে অনুরোধ করেও ফিরে গেছে। আজ আবার এসেছে। সুশান্ত অনীতা দুজনেই তাগিদ। দিচ্ছে, নিচে এসে ভদ্রলোকের সঙ্গে একটু আলাপ করো না মা, এই নিয়ে তিন দিন এলেন।
-বসতে বল।
ইন্দিরা উঠলেন। পরনের শাড়িটা খুব পরিষ্কার নয়। বদলালেন। সেই মুহূর্তে স্বামীর সেই নোটবইটার কথা মনে হল তার। চরিত্রচিত্রণের প্রসঙ্গে কি-ভাবে না কেটে স্বামী কি করতেন, দেখাবেন।
বার করলেন। শেষের দিকের কটা দিন কি আঁকিবুকি করেছেন দেখার জন্য ওটা খুললেন। তারপরেই অবাক একটু। আঁকিবুকি নয়, লেখা। বিছানায় বসে পড়তে লাগলেন। যত পড়ছেন ততো গম্ভীর।
একেবারে শেষের কটা লাইন–ওপরে তারিখ দেওয়া। …মানুষের চরিত্র নিয়ে। সমস্ত লেখক জীবন ধরে যে এভাবে ভাওতাবাজী করে গেলাম, নিজেই জানতাম না। যে লোক নিজের চরিত্রের ঠিকানা জানে না, হদিস জানে না, সেই লোক অনন্য চরিত্রস্রষ্টা–এর থেকে হাসির ব্যাপার আর কি হতে পারে!
ইন্দিরা নিষ্প্রাণ স্তব্ধ মূর্তির মতো বসে আছেন। ছেলে আবার তাগিদ দিতে এলো, মা এলে না?
-না, চলে যেতে বল।
মায়ের এই মুখ দেখে আর তার হাতে এবার কালো নোটবই দেখে ছেলে স্মৃতির শোক ভাবল। বলল, তাহলে আর এক দিন আসতে বলি?
–কোন দিন না। আমার দ্বারা এ-সব হবে না বলে দে।
নোটবইটা হাতে নিয়ে ইন্দিরাই আগে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
সহাবস্থান
মস্ত বাড়ি, দুতিনখানা ঝকঝকে গাড়ি আর টাকাপয়সার ছড়াছড়ি-কিন্তু এমন পরিবারেও কি ঝগড়া-ঝাটি, খিটিমিটির লেগেই থাকে না? অথচ স্বভাবে দুজনের একজনেও ঝগড়াটে নয়?
প্রশ্নটা আমাকে করেছিল বোম্বাইয়ের মাস্টার সাহেব।
বোম্বাইয়ের মাস্টার সাহেব বলতে সেখানকার লোক নয়। বাঙালী। পঁচিশ বছর বয়সে ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টায় বম্বে চলে গেছল। বেশ শক্তসমর্থ পুরুষের চেহারা ছিল তখন। বি-এ পাশ। বাপ দাদা কেরানী। ফলে কেরানীগিরির ওপর ঘেন্না। কলকাতার। সিনেমা এলাকায় কিছুকাল ঘোরাঘুরি করেছে। আর এদিকে এক চৌকস হিন্দুস্থানী শিক্ষকের কাছ থেকে বেশ মন দিয়ে হিন্দী শিখেছে। তার জন্য পয়সা খরচ করতে হয়নি। তার আগ্রহ দেখে ভদ্রলোক নিজেই যত্ন করে শিখিয়েছে। হিন্দীর দুদুটো ডিপ্লোমা পরীক্ষায়ও ভালো পাশের সার্টিফিকেট তার ছাত্রের পকেটে এসেছে। মোট কথা, কলকাতায় সুবিধে হল না দেখে মাস্টার সাহেব (তখন নাম অমর ঘোষ) যখন বোম্বাই পাড়ি দিয়েছিল, তখন সে টগবগ করে হিন্দী বলতে পারে, ইংরেজী বলতে পারে।–বাংলা তো পারেই।
কিন্তু অর্থভাগ্যটা কোনদিনই তার সুবিধের নয়। বোম্বাইয়ের ছবির বাজারে তখন রাজপুত্র মার্কা হিরোর কদর। অনেক কষ্টেও ভদ্রলোক পাত্তাই পেল না। ছোটখাটো রোলে কিছু চান্স পেয়েছিল। কিন্তু সেখানে তৃতীয়-চতুর্থ সারির আর্টিস্টদের কোন অস্তিত্বই নেই। নায়ক-নায়িকা ছেড়ে টেকনিসিয়ানদেরও তারা করুণার পাত্র। কিন্তু একজন মাঝারি প্রোডিউসারের চোখে তার যে গুণটি ধরা পড়েছিল সেটা অভিনয় নয়। সেই প্রয়োজকটির নাম অজিত বরিসকর। তার একটি বুদ্ধিমান কর্মঠ বিশ্বস্ত লোকের দরকার ছিল। সে সোজাসুজি তাকে বলেছিল, অভিনয়-টভিনয় কোনোদিন তোমার দ্বারা হবে না। আমার এদিকের হিসেবপত্র রাখা, আর বাড়িতে তিনটি ছেলেকে পড়ানোর জন্য একজন ভালো লোক দরকার। এজন্য মাস গেলে আমি তোমাকে তিনশো টাকা মাইনে দেব। থাকার জন্য আমার বাড়িতেই আলাদা ঘর পাবে–বিনে পয়সায় খাওয়া-দাওয়াও পাবে। সকালে ছেলে পড়াবে, দুপুরে স্টুডিওতে এসে আমার কাজকর্ম দেখবে। ছোটখাটো এক-আধটা রোল যদি পাও করবে–সেটা তোমার বাড়তি রোজগার।