প্রশান্ত মিত্র নোটবই বন্ধ করলেন। কলমও। সিগারেট না খেয়ে পারা যাচ্ছে। না। হাঁক দিলেন, মহেশ!
মহেশ এলো।
–তোর মা কোথায়?
–এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা কইছেন।
–চলে গেলে ডেকে দিস।
সাত আট মিনিটের মধ্যে ইন্দিরা এলেন। –ডাকছিলে?
–হ্যাঁ। বড় তেষ্টা।
–সে কি! ইন্দিরা সচকিত। –মহেশ কোথায়, এক গেলাস জলও দিতে পারেনি?
–জলের তেষ্টা নয়। সিগারেটের।
ইন্দিরা থমকে দাঁড়ালেন। চোখে চোখ।–আজ এরই মধ্যে একটা বেশি খেয়েছ না?
মুখ কাচুমাচু প্রশান্তবাবুর।–তাহলে অন্তত আধখানা…
ইন্দিরা হেসে ফেললেন।–কি যে করো না তুমি! সত্যি আধখানা কেটে আনছি।
দু মিনিটের মধ্যে ফিরলেন। হাতে আধখানা সিগারেট আর দেশলাই।
প্রশান্তবাবু সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে বড় টান দিলেন। ইন্দিরা মোড়া টেনে। বসলেন।
–কে এসেছিল?
–এই বাংলার সম্পাদক সঞ্জয় ঘোষ। তোমার শরীরের খবর নিচ্ছিলেন, কিন্তু আসল মতলব কবে থেকে তোমাকে লেখানো যাবে জানা। ওঠার আগে বলেই গেলেন, এবারে প্রথম যে লেখাটি ধরবে সেটা তার–তোমাকে যেন বলে রাখি।
আধখানা সিগারেট আর দুতিন টানে ফুরিয়ে এলো। ইন্দিরা বললেন, তার খানিক আগে তোমাদের প্রোডিউসার বিজন চাকলাদার ফোন করেছিলেন, তোমার কি গল্প নিয়ে জরুরী আলোচনা দরকার। আমি বলে দিয়েছি সামনের সপ্তাহের আগে হবে না–তাও কেমন থাকো না থাকো ফোন করে আগে জেনে নিতে।
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে প্রশান্তবাবু বললেন, আসতে বললেই পারতে, টাকাও তো দরকার।
-থাক। যা আছে ওই দুটোর উচ্ছন্নে যাবার মতো যথেষ্ট। নিজের বিশ্রামের কথা ভাবো।
প্রশান্তবাবু হাসলেন।ওদের ওপর তোমার এত রাগ কেন? সুশান্ত চাকরি করবে কি করে, চাকরির নামেই আমার তো হৃৎকম্প হত। আর অনীতা-তো বলেই দিয়েছে এম. এ পাশ করার পর বিয়ের কথা।
ইন্দিরা অখুশি মুখ করে জবাব দিলেন, জানি না বাপু, কারো মতিগতি বুঝি না।
কটা দিন ভেতরটা বেশ হালকা লাগছিল প্রশান্তবাবুর। মনের বিজ্ঞানীরা বলেন, নিজের ভেতর দেখা গেলে অনেক দুর্বোধ্য বা অগোচরের জট খুলে যায়, স্নায়ু শিথিল হয়, বশেও থাকে। প্রশান্তবাবুর সদ্য অনুভূতিও অনেকটা সেই গোছের। কিন্তু পরের ছসাত দিন আর ওই নোটবই খুলে বসার অবকাশ পেলেন না। ছেলেমেয়ে আর সপরিবারে শ্যালক এসেছে দিল্লি থেকে। ভগ্নিপতির অসুস্থতার খবর পাওয়ার পর থেকেই আসতে চেষ্টা করছিল।
ছদিন বাদে তারা চলে যাবার পর এতবড় বাড়ি আবার খালি। বিকেলের দিকে ইন্দিরা কি কাজ সারতে বেরিয়েছেন। ছেলেমেয়েও বাড়ি নেই। প্রশান্তবাবু বারান্দায় ইজিচেয়ারে। সামনের কাঠের টুলে সেই মোটা বাঁধানো নোটবই আর কলম। ওটা খুলে বসার জন্য ভেতরটা অনেকক্ষণ ধরে লালায়িত হয়ে উঠেছিল। এই রকম নিরিবিলি ফুরসতের অপেক্ষাতেই ছিলেন। ভিতরের যে মানুষটা ওই হিজিবিজি চিন্তার মিছিলের নায়ক, আয়নায় দেখার মতো তাকে এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কারণ প্রশান্তবাবুর মতো সেও এক পরিণতির মোহনার দিকে পা বাড়িয়েছে। তফাৎ শুধু, তার সত্তা সকলের দেখা সকলের জানা প্রশান্ত মিত্রর থেকে বরাবরকার মতো আজও বিচ্ছিন্ন। নোটবই খুলে প্রশান্তবাবু কলম নিয়ে ঝুঁকলেন।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে! কতক্ষণ আর কতটা এমনি নামের আশ্রয়ে একাগ্র হতে পারলে ভিতরটাকে নিরাসক্ত নির্লিপ্ত করা যায়? হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ…। টেলিফোন।…হ্যালো। হ্যাঁ বুঝেছি। শুনুন বনবাবু, বই পেয়েছি। গুনে দেখেছি সমস্ত বইয়ে তিরিশটা ছাপার ভুল। আর আপনাকে বই দেব কিনা ভাবতে হবে। আপনার পাবলিসিটিও আমার খুব পছন্দ হচ্ছে না। যাক, পুরো তিন এডিশনের টাকা পাঠিয়ে দিন। আচ্ছা।…হরে রাম হরে রাম…বই লেখাটা নেশা না টাকা রোজগার নেশা? একটার সঙ্গে আর একটা। তফাৎ করা যায় না। যেমন গোলাপ আর তার গন্ধ। তফাং করা যায় না। এই পৃথিবীতে আসা কেন? গাদা গাদা বই লিখতে? আর টাকা রোজগার করতে? ঠিক আছে, অনেক ই অঢেল টাকা–তারপর কি? তারপরে কিছু না থাকলে ভিতরটা আশ্রয়। খোঁজে কেন? সেটা কেমন আশ্রয়? তার ঠিকানা কি? হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে…। টেলিফোন। হ্যালো…না, অনীতা বাড়ি নেই। জানি না। জানি না। ..মেয়েটার চালচলন আবার অন্যরকম ঠেকছে। আবার কার সঙ্গে গিয়ে ভিড়ল কে জানে? প্রায়ই এই গলার ফোন আসে। একবার ঘা খেয়েও মেয়েটার শিক্ষা হয়নি। বিকেলে বেরোয় রাত করে ফেরে। খুব বুদ্ধিমতী ভাবে নিজেকে। সকালের কাগজ খুলেই অঘটনের ছড়াছাড়ি। সেভাবে কাগজ পড়ে না, সাবধান হওয়ার দরকারও ভাবে না। অঘটনের বরাত যেন সব সময়েই অন্যদের, ওদের নয়!…শুধু মেয়ে কেন, ছেলেটাও কোন রাস্তায় হাঁটছে ঠিক নেই। মেয়েদের ফোন তো লেগেই আছে। বাপ প্রেমের গল্প লেখে আর বাপের পয়সায় খেয়ে ছেলে প্রেম করে। মা সেভাবে বেঁকে না বসলে একবার তো কোন যাত্রাপার্টির মেয়ে এনে ঘরে ঢুকিয়েছিল প্রায়! যাকগে, ভেবে কি হবে? যার যেমন অদৃষ্ট। হরে কৃষ্ণ হরে রাম, রাম রাম…। টেলিফোন। হ্যাঁ-লো।…হা শর্মাজী বলুন। ছবি সুপারহট শুনেছি। থ্যাঙ্ক ইউ, কিন্তু গল্পের পিছনে আপনি এভাবে লেগেছিলেন বলেই এতটা সাকসেস।…কোন গল্পটা? ও হ্যাঁ…না এখনো কনট্রাক্ট হয়নি, ফ্রী আছে। বেশ তো, কিন্তু এতবড় সাকসেসের পর নতুন গল্পে লেখকও একটু বাড়তি মর্যাদার আশা খে-হাঃ হাঃ হাঃ।…বাংলার সঙ্গে হিন্দীও কনট্রাক্ট হবে? ওয়া শুরফুল! ঠিক আছে, একটা দিন দেখে সকালের দিকে চলে আসুন, নময়ার নমস্কার।..বাংলা হিন্দী একসঙ্গে কনট্রাক্ট মানে খুব কম হলেও পঞ্চাশ হাজার টাকা। সাদা কালো আদাআধি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দক্ষিণের বাতাসটুক বেশ মিষ্টি লাগছে। বাঃ ভারী সুন্দর দেখতে তো মেয়েটা! ফর্সা লম্বা সুঠাম স্বাস্থ্য। মেয়েটা নয়, কারো ঘরের বউ হবে। রাস্তার অনেক জোড়া চোখ টেনে হেসে হেসে আর এক মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চলেছে।…ধেং! সুন্দর মেয়ে মিষ্টি মেয়ে দেখতে সকলেরই ভালো লাগে–ভালো কথা। কিন্তু তিরিশ বছর আগের চোখ দিয়ে দেখা কেন? ছিঃ! হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে