নোটবই আর কলম বন্ধ করে প্রশান্তবাবু আবার ইজিচেয়ারে গা ছেড়ে দিলেন। ভিতরটা বেশ হালকা লাগছে। আরো মিনিট দশেক বাদে ইন্দিরা ফিরলেন। টুলে নোটবই আর কলম দেখে আঁতকে উঠলেন।–এইজন্যেই তো আমি বেরুতে চাই না, এরই মধ্যে নোটবই আর কলম নিয়ে তুমি লেখার ছক কাটতে বসে গেলে? ঘুরে দাঁড়িয়ে ইন্দিরা ঝাঝালো গলায় ডেকে উঠলেন, মহেশ!
সন্ত্রস্ত মহেশ তক্ষুনি হাজির। ইন্দিরা কিছু বলার আগেই প্রশান্তবাবু আদেশ দিলেন, দরকার নেই, যা—
মহেশ সরে যেতে হাসিমুখে স্ত্রীর দিকে ফিরলেন, মহেশও আমার ওপরে। গার্জেনগিরি করতে পারেনি কেন সেই কৈফিয়ত তলব করতে যাচ্ছিলেন?
ইন্দিরা মনে মনে অপ্রস্তুত একটু। ফলে জবাবের ঝাঁঝ আরো বেশি। তুমিই বা এমন অবুঝপনা করবে কেন–এখন তোমার লেখার প্লট ঠিক করার সময়?
কালো নোটবই মানেই লেখার প্লটের নক্সা বা খসড়া ভাবেন। জবাব না দিয়ে প্রশান্ত মিত্র গম্ভীর মুখে চেয়ার চেড়ে উঠলেন। ডাকলেন, এসো
ফোনটা যে ঘরে সরানো হয়েছে সেই ঘরে চললেন। ইন্দিরা পিছনে। দ্রুত এগিয়ে হাত ধরতে পারলেন না। হঠাৎ কি হল ভেবে পেলেন না। স্বামীর এই গোছের গাম্ভীর্যকে একটু সমীহ করেন।
ঘরে ঢুকে প্রশান্তবাবু ফোনের রিসিভার তুলে নিলেন। ডায়েল করলেন। ইন্দিরা এখনো কিছু না বুঝে চেয়ে আছেন। একটু বাদেই স্বামীর কথা থেকে বুঝলেন, কাকে ফোন করা হল এবং লাইনের ও-ধারে কে। হার্ট স্পেশালিস্ট, যিনি গত একমাসের মধ্যে অনেক দিন বাড়ি এসে রোগী দেখে গেছেন।
সাড়া পেয়েই প্রশান্তবাবু বললেন, আমার স্ত্রীর আমার বিরুদ্ধে ভীষণ নালিশ আছে।…এঁর মুখেই শুনে আপনার যা বলার ওঁকে বলুন আমার মনে হচ্ছে। একাসেরও পরে এমন কড়াকড়ি চললে আবার আমাকে বিছানা নিতে হবে।
রিসিভারটা ইন্দিরার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। তার বিড়ম্বিত মুখখানা মিষ্টি লাগছে। অপেক্ষা না করে গম্ভীর মুখেই প্রশান্তবাবু ঘর থেকে নিজের শোবার ঘরে চলে এলেন।
মিনিট পাঁচেক বাদে ইন্দিরা এলেন। অনুযোগের সুরে বললেন, তুমি ডাক্তারকে ঘুষ খাইয়ে রেখেছিলে নাকি?
প্রশান্তবাবু শব্দ করেই হেসে উঠলেন। নালিশের জবাবে পেশালিস্ট ডাক্তার কি বলে থাকতে পারেন এই থেকেই বোঝা গেল।
ইন্দিরা এবারে উৎসুক একটু।–তা এতবড় অসুখ থেকে উঠেই হঠাৎ কি? মা এল তোমার?
ভিতরে ভিতরে একটু বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে গেলেও প্রশান্তবাবু নির্লিপ্ত জবাব নিজে নোটবইটা খুলে নিজেই দেখো কি প্লট।
পাছে সত্যি ওটা খোলে সেই জন্যেই বলা কাজ হল। ইন্দিরা বললেন, আ-হ, তোমার ওই নক্সা আর আঁকিবুকি দেখে কি বুঝব। শুনিই না কি প্লট, এই এ নিয়ে কিছু না তো?
প্রশান্তবাবু হাসি মুখেই মাথা নাড়লেন। এ-সব কিছু না।
পরদিন। বিকেলে আগের দিনের মতোই প্রশান্তবাবু বারান্দার ইজিচেয়ারে বসেহন। কাঠের টুলের ওপর নোটবই কম। ইন্দিরা আজ এ নিয়ে কোনো আপত্তি তোলেননি। বড় ডাক্তার কাল বলেছেন, একটু একটু করে নিজের কাজের মধ্যে ফিরে আসতে চাওয়াটাই সব থেকে সুস্থতার লক্ষণ। পাশের মোড়ায় বসে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলেছেন। তারপর স্বামীর বিমনা ভাব লক্ষ্য করে উঠে গেছেন। নতুন কিছু সৃষ্টির আগের এই তন্ময়তা খুব ভালো চেনেন।
প্রশান্ত মিত্র সত্যিই বিমনা আর তন্ময় হয়ে পড়েছেন কোনো সৃষ্টির তাগিদে ন গজের মধ্যে সেই হিজিবিজি ব্যাপারটা শুরু হয়ে গেছে। চিন্তার এলোমেলো মিহি সচল অবাক ছবির মতো সার বেঁধে চলেছে। তারই ভিতর থেকে চোখের সামনে একখানা মুখ ধরে রাখার চেষ্টা। তারই ভিতরের আর একখানা মুখ।
খুব স্পষ্ট করে ধরা গেল। প্রশান্তবাবুর ঠোঁটের ফাঁকে হাসির টুকরো। নোটবই খুলে কলম নিয়ে কুঁকলেন।
…তাড়াতাড়ি দাড়ি কাটতে গিয়ে গাল কেটে গেল। কাটুক। গলাটাই কাটতে ইচ্ছে করছে। নাকেমুখে গুঁজে এক্ষনি দশটা-পাঁচটার অফিসে ছোটো। চাকরি না। তো ফাঁসির দড়ি। ভাবতে গেলে কান্না পায়। পায়ের তলায় মাটি সরে সরে যায়। গলা বুক শুকিয়ে আসে। দুচোখ সত্যি সত্যি জলে ভরে যায়। রাগে নিজের ওপরেই হিংস্র কিছু করে বসতে ইচ্ছে করে। সকলের অগোচরে বাথরুমে ছুটে যেতে হয়। চোখে জলের ঝাঁপটা দিয়ে আসতে হয়। তারপর চোখ মুখ মুছে পাউডার বুলিয়ে নিলেই সক্কলের চোখে সপ্রতিভ স্মার্ট। …যে কাণ্ড এ পর্যন্ত অনেকবার ঘটে গেছে। আবারও সেই কাণ্ড! সেকশন অফিসারের সঙ্গে সামান্য কারণে কথা-কাটাকাটি, তারপরেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সোজা বাস্তায়। মুক্তির স্বাদ। তারই সঙ্গে অনিশ্চয়তার আতঙ্ক। মুক্তির স্বাদ থেকে দিনে দিনে আতঙ্কটাই বড় হয়ে উঠছে। শুভার্থীজনেদের উপদেশ শ্লেষের মতো কানে বেঁধে। লিখে আবার এ-দেশের মানুষ খেতে পরতে পায়। নিজের চেষ্টায় আর রোজগারের সর্বস্ব খুইয়ে এ-পর্যন্ত চার-চারটে উপন্যাস ছাপা হয়েছে কিন্তু এতটুক আলোর হদিস কোথাও নেই। কেউ চেনে না। কেউ জানে না। পাবলিশারের কাছে খোঁজ নিতে গেলেও মুখঝামটা খেতে হয়–বই বিক্রি হয় নি। হলেও হিসেব চাইলে আবার মুখঝামটা। মাসিকে সাহিকে লেখা পাঠালে অবধারিত ফেরত। পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকের দরজায় ধর্না দিলেও কেউ উল্টে দেখতে চায় না। সম্মানবোধ প্রহর, অথচ সর্বদা মাথা নিচু। আত্মীয়-পরিজনের করুণার পাত্র। …নির্জন দুপুরে ছাতে উঠেছে। তারপর সভয়ে সরে গেছে। নিচের দিকে তাকাতে কে যেন মন্ত্রণা দিচ্ছিল, ইচ্ছে করলে এক্ষুণি সব যন্ত্রণার শেষ হতে পারে।…মায়ের ঠাকুরঘর। ভিতরে ঢুকে নিঃশব্ধে দরজা দুটো ভেজিয়ে দিল। তারপর মায়ের পটের সামনে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল। মা-গো শুধু এই দাও, যেন কোনদিন কারো গলগ্রহ হতে না হয়..মা কি শুনল? নইলে দুমাস না যেতে হ্যাং অমন যোগাযোগ কেন? যেখানে ফিচার লিখে ভিক্ষের মতো পাচিশ তিরিশ টাকা করে হাত পেতে নিতে হত, সেখান থেকেই গল্প লেখার আমন্ত্রণ পেল কেন–গল্পের পরে উপন্যাস লেখার ফরমাস!…সেই থেকে বৃত্তবদল। বাজারে ফি বছর দুতিনটে করে উপন্যাসের জমজমাট বিক্রি। কটি উপন্যাস সিনেমায় পরপর হাট। প্রকাশকরা যেচে আসছে। ছবির প্রযোজকরা খাতির করছে। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাছেও খাতির কদর বেড়ে চলেছে।..সুরা সরকারের ফোন। খিলখিল হাসি। আপনি প্রোডিউসারের কাছে আপনার গল্পের নায়িকা হিসাবে আমার নাম সাজেস্ট করেছেন শুনলাম, অনেক ধন্যবাদ। মঞ্জুশ্রী ওর সামনাসামনি অভিমান, কিছু বলছেন না নেই আমার অভিনয় আপনার ভালো লাগেনি! এই শটটা আর একবার নিয়ে দেখব?…রাতের শয্যায় কল্পনার পথ ধরে ওই দুই অভিনেত্রীকেই চোখের সামনে দেখা যায়। কখনো সুরমা সরকার। কখনো মঞ্জুশ্রী গুপ্ত। ভেতরটা লালায়িত হয়ে ওঠে। হাত দুটো পাশবালিশের ওপর নিশপিশ করে। ইচ্ছে করলেই কল্পনায় ওদের খুব কাছে টেনে আনা যায়। তারপরেই হাতের ধাক্কায় পাশবালিশটা ছিটকে মাটিতে পড়ল। আবার? আবার পাপ? গায়ত্রীকে। মনে নেই? গায়ত্রী কিভাবে শুচিশুদ্ধ হল মনে নেই?…সমস্ত রাগ গিয়ে পড়েছে। ইন্দিরার ওপর। ওধারে ঘুমে বিভোর হয়ে লতিয়ে পড়ে আছে। ও জেগে থাকলে তো এরকমটা হয় না। ভালো যাকে বাসে সে ইন্দিরা ছাড়া আর কে? ফের মিথ্যে? অন্তত নির্জলা সত্যি কি?…ইন্দিরা যখন তোমার বুকে মাথা গুঁজে ঘুমোয় তখনো কি এক-একসময় ওই রমণী-দেহকে কেন্দ্র করে সিনেমার অভিনেত্রী ছেড়ে তোমার বইয়ের নায়িকারা পর্যন্ত কেউ কেউ ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে এসে হাজির হয় না?…