- বইয়ের নামঃ মুখোমুখি
- লেখকের নামঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃগল্পের বই
দাম্পত্য
ঘুম থেকে উঠতে একটু বেলাই হয় রমেনবাবুর। খাটুনির জীবনে এইটুকুই বিলাসিতা। আজ চোখ মেলে তাকিয়েই তার মনে হল কোথায় যেন এই সকালটার একটু ব্যতিক্রম অনুভব করছেন। বিছানায় শুয়েই চারদিকে তাকালেন। সামনের ছোট টেবিলে ট্রে-তে বেড-টি পট আর পেয়ালা। গত পাঁচ মাসের মধ্যে তিনি বেড-টি খেয়েছেন মনে পড়ে না। তার আগে অবশ্য ঘুম-চোখে এক পেয়ালা চা কোনরকমে গলাধঃকরণ করে আবার শুয়ে পড়তেন। চোখ মেলে ভালো করে তাকাতেনও না। সুমিত্রার তাগিদে উঠছি উঠছি করে মাথার ওপরের পাখার হাওয়ায় চা কিছুটা ঠাণ্ডা হলে দুচুমুকে পেয়ালা শেষ করে আবার শুয়ে পড়তেন। চা সমস্তদিনে রমেন চৌধুরী অনেকবার খান। কিন্তু ওই সাতসকালে সুমিত্রার তাকে চা গেলানোটা বিরক্তিকর লাগত। না খেলে, সেও যেন কালচারের হানি। রমেনবাবু অবশ্য কখনো এ নিয়ে আপত্তি করেননি। আজ থেকে বাইশ বছর আগে সুমিত্রা এ বাড়িতে পা-দিয়ে যা-কিছু করেছেন তার সব কিছুই তখন রমেনবাবু অম্লানবদনে মেনে নিয়েছেন। তাই পরে আর আপত্তির। কোন প্রশ্নই ওঠেনি।
কিন্তু পাঁচ মাস বাদে রঘু ব্যাটা ভুল করে আবার চায়ের ট্রে রেখে গেছে বোধহয়। পরক্ষণে নিজের গায়ের পাতলা চাদরটার দিকে চোখ গেল। ভোরের দিকে এখন সামান্য ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা পড়ে। তার মধ্যে মাথার ওপর পুরোদমে পাখা ঘোরে। ভোররাতে বেশ শীত করছিল রমেনবাবুর মনে আছে। কিন্তু ঘুম-চোখে পায়ের তলার চাদরটা আর খুঁজে পাননি তিনি।
রঘুটা সেদিন চাদর দিতে ভুলেছে ভেবে কুঁকড়ে শুয়েছিলেন আবার। কিন্তু এখন নিজের পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাদরে ঢাকা দেখছেন। ঘুমের মধ্যে। আবার কখন উঠে চাদর হাতড়ে পেয়েছেন এবং গায়ে দিয়েছেন মনে করতে পারছেন না।
আরো অবাক সামনের খোলা দরজার দিকে চোখ পড়তে। রঘু ভুল করে না। হয় বেড-টি রেখে গেল, কিন্তু দরজা দুটোও খোলা রেখে গেল? তাছাড়া তার ঘুমের মধ্যেই দরজায় পাট-ভাঙ্গা নতুন পর্দা লাগিয়ে দিয়ে গেল? ও-রকম মুগোরঙ্গের পর্দাগুলো সব সুমিত্রা নিয়েই গেছে ধরে নিয়েছিলেন। কারণ গত পাঁচ মাসের মধ্যে মাঝে একবার মাত্র এই ঘরের পর্ণা বদলানো হয়েছে, মনে পড়ছে। তাও রঘু নিজের পছন্দমতো ভারী একটা নীল পর্দা এনে লাগিয়েছিল। গত তিন মাস ধরে সেই পর্দাই ঝুলছিল। কি ভেবে বালিশের ওপর দিয়ে মাথা উঁচিয়ে পিছনের জানলা দুটোর দিকে তাকালেন রমেনবাবু। তার পরেই হাঁ একেবারে। দরজায় ওই মুগোপর্দা লাগালেই তার সঙ্গে ম্যাচ করে জানলায় ওই রংয়ের পর্দাই টাঙাতো সুমিত্রা। এখনো জানলায় সেই ম্যাচ করা ঝকঝকে পর্দাই দেখছেন রমেনবাবু। তিনি ঘুমুচ্ছেন আর সেই ঘরে ঢুকে রঘু নিঃশব্দে এত সব করে গেল দেখেও বিশ্বাস হচ্ছে না।
আস্তে আস্তে শয্যায় উঠে বসলেন তিনি। ঘরের চারদিকে ভালো করে তাকালেন আবার। ড্রেসিং টেবিলটা সাজানো, কোণের আলনাটা গোছানো। পাঁচ মাস আগে যেমন থাকত, সে রকমই অনেকটা।
ঘড়ি দেখলেন। নটা বাজে প্রায়। এত বেলা পর্যন্ত আগে ঘুমোতেন না তা বলে। ইদানীং বেলা হচ্ছে। অনেক রাত পর্যন্ত বই পড়েন বা জার্নাল-টার্নাল পড়েন। রাতের ঘুম কমেছে, ফলে সকালের ঘুম বেড়েছে।
-বাবা এখনো ওঠেনি রে রঘু?
বাইরে থেকে এই গলার শব্দ কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতরটা যেন ধপধপ করে লাফিয়ে উঠল রমেনবাবুর। একি শুনলেন তিনি? কার গলা শুনলো? এখন তিনি জেগে আছেন না ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছেন?
ওই গলার স্বর যার, সে পর্দা ঠেলে গলা বাড়ালো। তাকে বসে থাকতে দেখে মুখে হাসি ভাঙল। দুচোখ আনন্দে চকচক করছে।
সুমু– সৌমেন, রমেনবাবুর একমাত্র ছেলে। কুড়ি বছর বয়স। তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে একমুখ হেসে বাবাকে প্রণাম করল। বলল, খুব অবাক করে দিয়েছি তো? মা একটা চিঠি লিখে তোমাকে জানাতে বলেছিল আমরা আসছি। আমি বলেছি, না, যাচ্ছি যখন না জানিয়েই যাবো। বাবাকে অবাক করে দেব।
ছেলেকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন রমেনবাবু। বুকে চেপে ধরলেন। তারপর কি যে হয়ে গেল, নিজেও অপ্রস্তুত। যা কখনো হয়নি তাই হয়ে গেল। কেঁদে ফেললেন তিনি।
বাবার চোখে জল দেখে ছেলেটাও অপ্রস্তুত। তাড়াতাড়ি বলল, তুমি আর কিছু ভেব না বাবা। সব ঠিক হয়ে গেছে। মা আর তোমাকে ছেড়ে যাবে না, আমিও না। কি যে এক মজার কাণ্ড হয়েছে না মাদ্রাজে–একদিনে মায়ের মেজাজ জল– মনই ঘুরে গেল একেবারে, বলবখন তোমাকে–চুপ মেরে যেতে হল, পর্দা সরিয়ে সুমিত্রা ঘরে ঢুকলেন। বাপে-ছেলেতে তখনো জড়াজড়ি, রমেনবাবুর চোখে তখনো জল।
তাড়াতাড়ি ছেলেকে ছেড়ে দিলেন। নিজের ওপর হঠাৎ প্রচণ্ড রাগ হল রমেনবাবুর। এই একজনের কাছে চোখের জলসুদ্ধ ধরা পড়তে চাননি।
সুমিত্রা চুপচাপ তার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন একটু। সুমুও এই ফাঁকে মাকে দেখে নিচ্ছে।
সুমিত্রা স্নান সেরে এসেছেন। ভেজা চুল। ফর্সা মুখে ফোঁটা ফোঁটা জলের দাগ। আয়নার দিকে চলে গেলেন। ড্রয়ার খুলে চিরুনি বার করলেন।
পাঁচ মাস বাদে দেখা হবার পরে ঘরের তিনজনেই একেবারে চুপ মেরে গেলো অস্বস্তিতে। ছেলে একবার মাকে দেখে নিয়ে অনেকটা বেপরোয়ার মতো বলে ফেলল, তোমাকে প্রথমেই একটা সুখবর দিয়ে রাখি বাবা। এবার থেকে আমি তোমার সঙ্গে কন্ট্রাক্টরির কাজে লেগে যাবো। তোমার কাছে হাতেকলমে কাজ শিখবো।