-দেখো রাধু, এখন তুমি দিব্যি বুড়ো হয়েছে, আর তোমাদের সেই সাধিকা মা বেঁচে থাকলেও এতদিনে সে থুথুড়ি বুড়ি হয়ে যেত–আর হেসে হেসে নাতি বয়সী ছেলেদের কাছে নিজেই হয়তো নিজের রূপের কথা গল্প করত। তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখনো যেন তুমি তোমার সেই বয়সের মধ্যেই আটকে আছ।
শুনল মন দিয়ে, মাথা নেড়ে সায় দিল।তাই হইছে গো বাবু, ওই কালের মধ্যেই আটকে গেলম, তুমি আমাকে টেনে বার করতে লেগেছ…।
টেনে বার করছি সেটা যেন ওর মন্দ লাগছে না এখন। আমার সাগ্রহ প্রতীক্ষাটুকু ও ঠিকই অনুভব করল বোধহয়। আস্তে আস্তে জবাব দিল, সে কেমন রূপ তুমি ভাবতে পারবে না গো বাবু…দূরে নদীর ধারে যখন চিতা জ্বলত আমি মায়ের মুখের পানে চেয়ে চেয়ে দেখতম, আমার চোখে মায়ের রূপের আগ চিতার আগুনের পানা লাগত, কিন্তুক চিতার আগুনের মতো গিলতে আসত না–হেসে হেসে মা সেই আগুন যেন জলে ভিজিয়ে দেত গো বাবু!
ওর বক্তব্য বোঝা গেল। উপমাটুকু অদ্ভুত ভালো লাগল কানে। হাসিভেজানে রূপের আগুনের উপমা আর কখনো শুনিনি।
দ্বিধা কাটিয়ে পাপ কবুল করার মতো করেই একটু বাদে রাধু ভৃঙ্গী আবার বলল, আমি একটো শয়তান দুশমন ছিলম…খুব খারাপ ছিলম…খুব খারাপ ছিলম, উ মায়ের দিকে আমার চোখ লাগত, কামি ভুলতম, দিশা ফিরলে তখন শয়তানের টুটি ছিঁড়তে লাগতম আর নিজের চোখ তুলে আনার জন্যি ঘরপানে ছুটে যেতম…কিন্তুক চোখ গেলে মা-কে দেখতি পাবনি, বাবার সেবা করতে পারনি, তখুন তো জেবন যাবে! শেষে কেবল মা-মা মা-মা করতে লাগলম, আর মায়ের কাছে আলে ছোট বাচ্চার পানা কেবল মা-মা মা-মা করতম!
আমি কান পেতে শুনছি। সর্বক্ষণ কথায় কথায় ওই মা-মা শুনে সাধিকা নাকি এক-একসময় রেগে গিয়ে ভেঙচি কাটত, বলত, কেবল মা-মা করে কান ঝালাপালা করিস কেন, মা-কি তোর মরেছে–সামনে দেখতে পাচ্ছিস না!
ওর মুখ দেখে নাকি সেই রাগের মুখেই আবার হাসি ঝরত। বলত, কি বরাত আমার, সব খুইয়ে শেষে কিনা এক চণ্ডাল ছেলে…!
রাধুর মোট বক্তব্য, মায়ের এমনই রূপ যে বহুদিন কেবল মা-মা করে বিবেকের চাবুক হেনে তবে তার পাপ চক্ষু ঠাণ্ডা করতে হয়েছে। অথচ প্রথম দেখার দিন। থেকেই ওই মা-কে সে যেমন ভয় করত তেমনি ভক্তি শ্রদ্ধা করত।
শ্রী মুখোপাধ্যায়ের ভয়ে সেদিন আর দেরি না করে উঠে পড়তে হয়েছে। এরপর হয়তো শ্মশানেই লোক পাঠিয়ে বসবেন তিনি। রাধুকে বলেছি, কাল আবার আসব।
আপত্তি তো করেইনি, মুখে যেন একটু নীরব আগ্রহ দেখেছিলাম ওর। পরদিন এসেছি। তার পরের দিনও। কাঁধের ঝোলাতে ওর জন্যে কিছু খাবার এনেছিলাম। সেগুলো দেখে খুশি যেন ওর মুখ বেয়ে দাড়ি চুঁইয়ে পড়েছে। কতকাল ও ভালো খাবার চোখেও দেখেনি মনে হতে ভিতরটা আমার কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠেছিল।
তৃতীয় দিন আরো বেশি খাবারের সঙ্গে চাল-ডাল তরি-তরিকারিও এনেছিলাম। একটা মুটের মাথায় ঝুড়ি চাপিয়ে। সেই সব দেখে তো ওর ছোট চোখ জোড়া গোল একেবারে। পয়সা দিয়ে মুটে বিদেয় করে দেখি ওর সেই চোখে জল টলটল করছে। হাত ধরে আমাকে দাওয়ায় বসিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, তুমি কেতো ভালো। গো বাবু, কেতো ভালো…
বললাম, থাম তো বাপু, তুমি নিজে যে কতো ভালো তুমি নিজেও জানে না।
সঙ্গে সঙ্গে লোকটা যেন বিগড়ে গেল। ছোট চোখ ঘোরালো করে তাকালো আমার দিকে। তারপর ধমকেই উঠল যেন, তোমাকে বললম না আমি ভালো না–আমি শয়তান আমি দুশমন–উ এক কথা আর কেতো বার বলব?
-আচ্ছা বাবা হয়েছে, আমার তাকে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা, অমন শয়তান একটা করে সকলের মধ্যেই থাকে সে তুমি না বুঝলে আর কি করা যাবে!
সঙ্গে সঙ্গে ওই তপ্ত কালো মুখই বিষণ্ণ আবার। আমার ওপর ও-ভাবে ঝাঁঝিয়ে ওঠার দরুন হতে পারে আবার কোনো স্মৃতির দংশনের জন্যেও হতে পারে। একটু বাদে ঝাকড়া চুল-দাড়ি বোঝাই মাথা-মুখ ডাইনে-বাঁয়ে নেড়ে ক্লান্ত সুরে বলল, না গো বাবু না, তুমি জানো না আমি খুব খারাপ দুশমন…আমার লেগেই মহাশ্মশান খালি হইন গেল, আমার লেগে উ হামার মুণ্ডীর আসন খালি হই গেল, আর আমার লেগে মা সবকুছুতে আগ লাগায়ে দেল
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছি। যে প্রশ্ন করতে যাচ্ছি, বুঝতে পারলে ওই বৃদ্ধের বুকে নতুন করে আঘাত পড়বে একটা জেনেও সেই মুহূর্তে অন্তত অকরুণ। আমি–তুমি ঠিক বলছ যা হয়েছে সব তোমার জন্যে? আর কানো কারণ নেই? তুমি তোমার ওই মায়ের নামে শপথ করে বলতে পারো?
রাধু ভৃঙ্গী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল খানিক। আচমকা এই প্রশ্নটা বোধের অতীত যেন।
আরো স্পষ্ট করে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার জন্যে সব গেছে, সব নষ্ট হয়েছে –সেটা তোমার ঢের ঢের পরের চিন্তা, নাকি সেই ভয়ংকর দিনেও তোমার এই কথাই মনে হয়েছিল, এই অনুশোচনা হয়েছিল?
এবার যেন একটু অস্বস্তিবোধ করছে ও। আমি কিন্তু তেমনিই অকরুণ।–তোমার জন্যেই যদি সব নষ্ট হয়ে থাকে তো সেই দিন ওই অশ্বত্থ গাছের দিকে চেয়ে কেবল গলা ফাটিয়ে হেসেই চলেছিলে কেন? আর কেন তারপর তোমার মুন্নির জন্যে হাহাকার করে উঠেছিলে?
রাধু ভৃঙ্গী স্থাণুর মতো বসে! অসহায় দৃষ্টি। দীর্ঘ দিনের একটা শোক আর অনুশোচনার আশ্রয় থেকেও যেন ওকে টেনে বার করে আনা হল।