দুচোখের জরা ঠেলে ঠেলে ও আমাকে দেখতে লাগল। সন্দিগ্ধ, কুটিল চাউনি। স্পষ্টই বোঝা গেল শ্রী মুখোপাধ্যায়কে এবারে চিনেছে। কিন্তু ওই কালো মুখ সদয় নয় একটুও।-তুমি উ ঠাকুরের ছাওয়ালি বটে?
–ছেলে নয়, ছেলের মতো, আর ছেলের থেকেও বেশি। কলকাতায় থাকি, ওঁর কাছে এসেছি। তোমার গল্প শুনে তোমাকে না দেখে থাকা গেল না–
ছোট ছোট দুই চোখ চিকচিক করছে, কিছুটা বিস্ময়ে সংশয়ে।
-তুমি এত পথ আলে আমাকে দেখতে?
হাসিমুখে বিশ্বাসযোগ্যভাবে মাথা নাড়লাম। কিন্তু রাধুর মুখভাব ক্রমে যেন বিরক্তিতে ছেয়ে যেতে থাকল। ও যেন বুঝেছে আমি ওর শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে এসেছি।
জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বয়স কত হল রাধু?
বিড়বিড় করে জবাব দিল, কে জানে, দুতিন কুড়ি হবে–
আমার হাসি পেয়ে গেল, দু কুড়ি আর তিন কুড়ি ওর কাছে কাছাকাছি ব্যাপার। শ্রী মুখোপাধ্যায়ের থেকে কিছু ছোট হলেও ওর বয়েস সাড়ে তিন কুড়ি অর্থাৎ সত্তরের কম নয়।—-
আমাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ও দূরের ধান ক্ষেতের দিকে চেয়ে রইল। মনে মনে। ও আমাকে এখন বিদেয় করতেই চাইছে। আমি নাছোড়বান্দার মতো বললাম, এতদূর থেকে এলাম তোমাকে দেখতে, তোমার কথা শুনতে, আর তুমি মুখ ফিরিয়ে রইলে?
-দেখা তো হল…
–কিন্তু কথা তো হল না!
আবার সেই বিরক্তি, আর চোখের তারায় সংশয়।–আমি কি ভদ্দরলোক যে তোমার সঙতে হুড়হুড় করে কথাটি কব
জবাব দিলাম, ভদ্রলোকের কথা শুনতে হলে তো সেখানেই যেতাম, এই রোদে। এত পথ তেতেপুড়ে তোমার কাছে আসব কেন?
এবারে গলার স্বরও কর্কশ ওর।-তুমি কে বটে? ইভেনে কেন আসলে?
আমিও গলার স্বর একটু চড়িয়ে জবাব দিলাম, এক্ষুণি তো শুনলে কেআর কেন এসেছি সেটা না বুঝলে তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?
ছোট ছোট দুচোখ পাকিয়ে ও চেয়ে রইল। ওর চোখে চোখ রেখে আমি একটু জোরেই হেসে বললাম, দেখো রাধু, মুখুজ্জেমশাইকে মানে সেই ঠাকুরকে তুমি চেলা কাঠ নিয়ে তাড়া করেছিলে শুনেছি, কিন্তু তুমি রাগই করো আর যাই করো এখন। তোমার সে-বয়েস আছে না সেই জোর আছে?
নেই যে, সেই খেদও ওর চোখে-মুখে ফুটে উঠছে। তাই গলার সুর নরম করে বললাম, তবে সত্যিই যদি তুমি মনে ব্যথা পাও তো সে আলাদা কথা, বলো–চলে যাই।… কিন্তু সত্যিই বড় লোভ নিয়ে তোমার কাছে এসেছিলাম রাধু ভৃঙ্গী, ভেবেছিলাম। এখন তো তোমারও বয়েস হয়েছে, মনের কথা মনের মধ্যে পুষে রেখে কত কাল। ধরে একটা যন্ত্রণা ভোগ করছ–কিন্তু এখন এ-বয়সে তোমার আর লজ্জা-ভয় নেই, রাগ-ঘৃণা নেই–এখন তুমিই হয়তো সব কথা বলে ওই যন্ত্রণা হাল্কা করার জন্য কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছ। আমি তোমার সেই লোক হতে এসেছিলাম রাধু ভুঙ্গী…এখন দেখছি। ওই যন্ত্রণা বুকে চেপে মরে ভূত হয়ে এখানেই তুমি ঘুরঘুর করবে।
না, এবারে আর রাগ নয়, বিরক্তি নয়, কি একটা ভয় যেন জমাট বাঁধতে থাকল ওর ওই ছোট ছোট চোখে। একটু বাদে বিড়বিড় করে শুধালো, বুক হাল্কা না হলে মুক্তি হয় না বাবু?
ওর ভয় দেখে কেন যেন আমার কষ্ট হল। ও-রকম না বললেই ভালো হত যেন। অভয় দেবার মতো করেই জবাব দিলাম, ও একটা কথার কথা বললাম, কি করে মুক্তি হয় আমিই কি জানি?…তবে শেষ বয়সে লোকে সব কিছুর মায়া কাটিয়ে হাল্কা হতে চেষ্টা করে শুনি, তোমারই বা আর কিসের সংকোচ। তাছাড়া এত বছর ধরে এভাবে কাটিয়ে তুমি তো একটা খাঁটি মানুষ হয়েই গেছ-কজন পারে এতকাল এ-ভাবে কাটাতে।
বুড়ো রাধু ভৃঙ্গী যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেল আস্তে আস্তে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে দাড়ি ভরতি থুতনিটা ঘষতে লাগল। ও যেন অনেক দূরের কিছু দেখছে আর বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। বলল, না গো বাবু, আমি একটো শয়তান আমি একটা ডাকু…বাবার আসনে আর কেউ বসল না, মুক্তির লেগে আমি শুধু বসেই থাকলাম…কেউ আসল না রে বাবু।
-ওই বসে থেকে থেকেই তোমার মুক্তি হয়ে গেছে রাধু, ভগবানের মতো মানুষ না থাকুক, ভগবান তো আছেন–তিনিই তো সব দেখলেন সব বুঝলেন, মানুষ না-ই বা এলো!
কথাগুলো বুঝতে চেষ্টা করল। নির্বোধ অথচ ব্যাকুল চাউনি। শেষে জিজ্ঞাসা করল, কিন্তুক উ আসনের তাহলে কি হবে?
সান্ত্বনা দেবার মতো করে জবাব দিলাম, সময় হলে ভগবান পাঠাবেন কাউকে, বেঁচে যদি থাকি তখন না হয় তাকে এসে তোমার কথা বলে যাব…একটা লোক কতকাল ওই আসনের মালিকের আশায় শ্মশান আগলে বসেছিল সেই কথা–
নিজেই হেসে ফেললাম। ওরও কালো বিমর্ষ মুখে এবারে যেন একটু হাসির আভাস দেখা গেল। মন্তব্য করল তুমি বেশ লোক বাবু…।
খানিকক্ষণের জন্য আমি ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে এলাম। এখানে ওর খাওয়া-দাওয়া সংগ্রহ কোথা থেকে, খাবার জল পায় কোথায়, বর্ষার সময় জায়গাটার কি অবস্থা দাঁড়ায়, দারুণ শীতের সময়েই বা এই খোলা জায়গায় কি করে কাটা, গাঁয়ের লোকালয়ে কখনো যায় কিনা, ইত্যাদি খুঁটিনাটি ব্যাপারে দস্তুরমতো আগ্রহ দেখালাম।
রাধু ভৃঙ্গী টুকটাক জবাব দিতে লাগল। এই আলাপের মধ্যেই ও যেন এক একটু করে সহজ হতে লাগল।
আলাপের মোড় ফিরিয়ে উৎসুক আগ্রহে প্রায় আচমকা জিজ্ঞাসা করে বসলাম, আচ্ছা রাধু, মুখুজ্জেমশায়ের কাছে শুনেছি তোমাদের সেই বামাসাধিকার নাকি এমন রূপ ছিল যে চোখ ফেরানো যেত না, সত্যি নাকি?
ওর দুচোখ যেন আমার মুখের ওপর হোঁচট খেল একপ্রস্থ। কুতকুত করে চেয়ে রইল, কিন্তু আগের মতো বিরক্ত নয়।