যত দিন গেছে, একটা ধারণা রাধুর বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। বাবার সেবার তরেই সাধিকা-মা এখানে এসে শ্মশানবাসিনী হয়েছে। হয়তো এই সেবাটাই তার আসল সাধনা। বাবা যেন ছোট ছেলে একটা। তার ওপর মায়ের হম্বি-তম্বি ধমক-ধামক পর্যন্ত চলে। অবশ্য বাবা যখন সহস্রমুণ্ডীর আসনে বসে একেবারে পাথর হয়ে থাকে, তখন ওই মাটি কিছু বলে না, কোনরকম ব্যাঘাত ঘটায় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাবার মুখের দিকে চেয়ে বসে থাকে, কখনো কখনো আবার আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। যোগিনীর তখন যেন এক ভয়ংকর রকমের স্তব্ধ রূপ। কিন্তু বাবা যখন ধ্যানমগ্ন নয়, তখনই মায়ের ইচ্ছে মতো সেবাশাসন চলে তার ওপর। খাবার সাজিয়ে তাকে টেনে এনে খেতে বসায়, এক এক রাতে হিড়হিড় করে কুটীরে টেনে খড়ের বিছানায় শুইয়ে দেয়। যা মুখে আসে তাই বলে বকাবকি করে।
কিন্তু বাবা সেই বরাবরকার মতো শান্ত প্রসন্ন নির্লিপ্ত।
…শ্রী মুখোপাধ্যায় বামাসাধিকাকে এই মহাশ্মশানে প্রথম পদার্পণের পরেও দেখেছেন আবার বছর পাঁচেক বাদেও দেখেছেন। আর তার মাঝেও বার কয়েক দেখেছেন। না তার রূপ সম্পর্কে কেউ অতিশয়োক্তি করেনি। কিন্তু শ্রী মুখোপাধ্যায়ের নিজস্ব ধারণা রমণটি অপ্রকৃতিস্থ। রাধুর সঙ্গে কথা বলে বলে ধারণার অনুকূলে তিনি কিছু রসদও সংগ্রহ করেছিলেন। তাছাড়া, সে-রকম কোনো মানসিক বিপর্যয় না ঘটলে এই বয়সের আর এই রূপের বিপদ নিয়ে আত্মীয় পরিজনের আওতা ছেড়ে কেউ বেরিয়ে আসতে পারে না। প্রথম যখন দেখেছিলেন তাকে, তখন বছর চব্বিশ বয়েস মনে হয়েছিল। অর্থাৎ নতুন বাবার থেকেও বছর চারেকের বড় হবে। পাঁচ বছর। বাদে সেই শীর্ণ কশ নতুন বাবার শিখা-দীপ্ত অবয়বে ভরা যৌবনের স্পষ্ট রূপান্তর দেখেছেন–যদিও তখন সে আগের থেকেও কঠিন তপোনিবিষ্ট, আগের থেকেও বেশি শান্ত প্রসন্ন নির্লিপ্ত। কিন্তু শ্রী মুখোপাধ্যায়ের অবাক লেগেছিল পাঁচ বছর বাদেও সেই রূপসী সাধিকাকে দেখে। তার যেন একটা দিনও বয়স বাড়েনি, সেই জ্বলন্ত যৌবন কি-যেন এক জাদুর শেকলে বাঁধা পড়ে গেছে। বরং চোখের বিভ্রম কিনা শ্রী মুখোপাধ্যায়। জানেন না, পাঁচ বছর বাদে বামাসাধিকাকে যেন ওই নতুন বাবার থেকেও বয়সে ছোট মনে হয়েছে একটু। আর শ্রী মুখোপাধ্যায় আমাকে বলেছেন, সাধিকার স্থির রূপই দেখেছেন বটে তিনি–কিন্তু তার ধারণা সেই রূপ ভয়ংকর অস্থির হয়ে উঠতে পারে, আর তার আলো করা রূপের শিখাই দেখেছেন বটে তিনি–তবু মনে হয়েছে ওই শিখা কখনো বুঝি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতেও পারে। অবশ্য, গোড়া থেকেই রমণীটিকে অপ্রকৃতিস্থ বলে ধরে নিয়েছিলেন বলেই এই গোছের ধারণা তার মনে আসাটা বিচিত্র নয়, এ-কথাও স্বীকার করেছেন।
.
লোকটা বাইরের কাঁচা মাটির দাওয়ার একটা কাঠের থামে ঠেস দিয়ে বসেছিল। খালি গা, কুচকুচে কালো রঙ, পরনে হাঁটুর ওপর তোলা বিবর্ণ খাটো ধুতি। মাথার ঝাকড়া চুল এখনো কালো দিক ঘেঁষা। তেলজলের অভাবে লালচে দেখাচ্ছিল। দাড়ির বোঝা গাল বেয়ে বুকে এসে ঠেকেছে। সেই দাড়ি অবশ্য কাঁচা পাকার মিশেল! সোজা হয়ে বসে মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো যখন, দেখলাম চুল-দাড়িতে একাকার মূর্তি একখানা।
বললাম, একটু জল খাওয়াতে পারো রাধু, অনেক পথ রোদে হেঁটে বড় তেষ্টা পেয়ে গেছে।
পরিচিতের মতো নাম ধরে কথা বলতে শুনে ও ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল খানিক। ছোট চোখ, কিন্তু লক্ষ্য করলাম চাউনিতে যেন জরার ছোঁয়া লাগেনি, খুব বেশি।
কোন কথা না বলে উঠল। বিশাল একটা কাঠামোয় প্রাণবস্তু সক্রিয় হতে সময়। লাগল একটু। দাঁড়াবার পর বোঝা গেল দাওয়ায় ঝুঁকে বসেছিল না, ওর ওই অতবড় দেহটাই সামনের দিকে বেঁকে গেছে একটু। বয়সের ভারে আর হয়তো বা অনশনে অর্ধাশনে মোটা মোটা হাড়ের ওপর কালো চামড়া ঝুলে পড়েছে।
এগোতে গিয়েও দাঁড়াল আবার। বলল, আমি জেতে চণ্ডাল
ঝোলাটা কাঁধ থেকে নামাতে নামাতে আমি দাওয়ার ওপর বসে পড়লাম। হেসে বললাম, তুমি মহাশ্মশানের শ্মশানবন্ধু, তোমার আবার জাত কি গো! জল দাও, তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে গেল।
ও তাড়াতাড়ি ভিতরে চলে গেল। একটু বাদে ওর গায়ের রঙের মতই একটা কুচকুচে কালো পাথরের গেলাসে জল আর শালপাতায় একটা বড় বাতাসা এনে সামনে। রাখল। কোথাকার জল, কি জল, খাওয়া উচিত কিনা পথে বেরুলে এ-সব নিয়ে আমার খুঁতখুঁতুনি নেই। কালো পাথরের গেলাস হাতে নিয়ে খুশি মুখে বললাম, বাঃ, তুমি পাথরের গেলাসে জল খাও নাকি, কোথায় পেলে?
-আমি খাই না, ওটা ঘরে ছেল। বলতে বলতে শতখানেক গজ দূরের ওই দুটো কুটিরের ধ্বংসাবশেষের দিকে দৃষ্টি ঘুরে গেল ওর। আমার মনে হল, কয়েক নিমেষের জন্য বিমনাও হয়ে গেল। তারপর চোখ ফিরিয়ে আস্তে আস্তে আমার দিকে তাকালো আবার।-জল খেয়ে নাও, কোথা পেলাম উ খোঁজে কাজ কি?
জল, বাতাসা খেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।-তুমি বোসো রাধু, দাঁড়িয়ে কেন?
আমার মুখের ওপর ওর ঘোট ঘোট চোখ দুটো নড়েচড়ে বেড়াতে লাগল। ওই থামে ঠেস দিয়েই মুখোমুখি বসল আবার।আমার নাম তোমাকে কে বলে দেল?
শ্রী মুখোপাধ্যায়ের নাম বলে দিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, চিনলে?
ও চুল-দাড়ি বোঝাই মাথা নাড়ল। চিনল না।
গাঁয়ের নাম করতেও চিনল না, চেহারার বর্ণনা দিতেও না। হঠাৎ ওকে একটা বেপরোয়া ধাক্কা দেবার মতলব এলো আমার। বললাম, তোমার কাছে সে প্রায়ই আসতো গো, তুমি তাকে খুব মান্যি করতে, তার কাছে সেই নতুন বাবা আর বামাসাধিকার গল্প করতে–আর তাকেই শুধু একদিন তোমার মুন্নির কথা বলেছিলে, জিজ্ঞেস করেছিলে, মুন্নিকে এখন কোথায় পাই?…মনে পড়ছে?