হঠাৎ নিজের কুটীরে বসে রাধুর মনে হল ওই নির্জন দুপুরে ধ্যান-নিবিষ্ট বাবার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ। রাধু দিনমানেই ডেরায় লুকিয়ে মদ খাচ্ছিল। এখন এ জিনিসটা লুকিয়ে-চুরিয়ে খেতে হয়–বাবা টের পেলেই ধমক-ধামক করে। রাধু অবশ্য বলে, মহাদেওর ভৃঙ্গী নেশা করলে দোষ কি! প্রসন্ন থাকলে বাবা সেই কথা শুনে। হাসে।
দুচোখ ভাল করে রগড়ে নিয়ে দেখতে লাগল রাধু ভৃঙ্গী। ঠিক দেখছে না মদের ঘোরে দেখছে? কারণ বাবার সামনে এক রমণীকে দেখছে সে। এক পিঠ খোলা। চুল কোমরের নীচে নেমে গেছে। পরনে থান। সোনার বরণ দুই হাত কোমরে।
রমণী অবশ্য অনেক আসে, কিন্তু এই নির্জনে একলা কে আসবে? পাগল-টাগল নাকি!
নেশার পাত্র রেখে রাধু ছুটে এলো। তারপর হতভম্ব সে। রমণীই বটে। কিন্তু এমন রূপসী রমণী কি সে আর দেখেছে? তার সর্বঅঙ্গ যেন আগুনের লাল হক্কা নিয়ে তৈরি। রমণী বাবাকে দেখছে। দেখছেই দেখছেই দেখছেই। তার চোখ দিয়ে। মুখ দিয়ে সর্বঅঙ্গ দিয়ে যেন আগুনের তাপ ঝরছে।
অদূরে দাঁড়িয়ে বিস্ফারিত নেত্রে তাকে দেখছে রাধু ভৃঙ্গী।
হঠাৎ এতবড় শ্মশানের স্তব্ধতা খানখান করে রমণী হেসে উঠল। খিল খিল হাসি। এমন রক্ত জল করা বেদম হাসিও রাধু আর দেখেনি বা শোনেনি। হাসছে। তো হাসছেই। দুই হাত কোমরে তখনো। হাসির দমকে সেই অবস্থায় তার অঙ্গ বেঁকে চুরে যাচ্ছে।
রাধু ভাবল, এ পাগলিনী। নইলে কাঠফাটা রোদে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে এভাবে কেউ হাসতে পারে না।
কিন্তু পরক্ষণে তার কথা শুনে রাধু বিষম চমকেই উঠল বুঝি। রমণী হাসছে তেমনি আর বার বার করে বলছে, আমি চিনেছি ঠিক চিনেছি, তুমি আমাকে ফাঁকি দেবে ভেবেছ? আমাকে?
আবার সেই হাসি।
রাধু নিস্পন্দ। কিন্তু যাকে দেখে রমণীর এত হাসি এত উল্লাস, সেই নতুন বাবা তেমনি স্থির নিশ্চল ধ্যানমগ্ন। একবারও চোখ মেলে তাকায়নি, হাসিতে বা কথার এতটুকু রেশ কানে ঢোকেনি।
এই ব্যতিক্রমটা রমণীরও চোখে পড়ল যেন, মুখের হাসি মেলায়নি, আবার ভুরু কুঁচকে দেখতে লাগল বাবাকে। তারপর বিড়বিড় করে বলতে লাগল, চিনেছি, ঠিক চিনেছি, ঠিক ঠিক ঠিক
রাধুর নেশা ছুটে গেছে ততক্ষণে। বুকের ভিতরটা ঢিপ ঢিপ করছে।
রমণীর চোখে এবার হাসির আগুন ঝরল। বলল, হাঁ মহাদেও–আর তুই বুঝি তার চেলা?
সভয়ে মাথা নাড়ল রাধু। বলল, আমি ভৃঙ্গী।
আবার এক পশলা হাসি। হাসির শেষে বাবার দিকে ফিরল। বাবা তেমনি তপোনিবিষ্ট। রমণী ভুরু কুঁচকে এবারে একটু বিস্ময়ভরেই দেখতে লাগল তাকে।
নতুন বাবাকে চিনেছে শুনেই আর পাগল-টাগল ভাবার সাহস নেই রাধুর। সভয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কে আছ গো মা?
-আমি? আমি কে দেখেও চিনতে পারছিস না হাঁদা কোথাকারের! জ্বলজ্বল মুখখানা বাবার দিকে ফেরালো আবার।-হ্যাঁ রে, তোর মহাদেওর চোখ-কান সব আছে তো, না-কি খেয়ে বসে আছে?
রাধু হাঁ করে চেয়ে রইল তার দিকে।
বিকেলের মধ্যে এক গা ছেড়ে তিন গাঁয়ে রটে গেল ব্যাপারটা। তারপর আরো দূরে দূরে। দলে দলে লোক ছুটল মহাশ্মশানের দিকে। এই বিচিত্র রমণীর আগুনের মত রূপ দেখে নির্বাক, তার উচ্ছল হাসি দেখে এস্ত, কথা শুনে হতভম্ব। তাকে দেখার আগে সাধারণ মানুষের ঔৎসুক্য একরকম, আবার দেখার পরে অন্যরকম। দেখার পরে রসালো মন্তব্য করতে বা জটিল কিছু ভাবতে ভয়।
বাবার বিশেষ স্নেহের পাত্র হিসেবে রাধু ভৃঙ্গীর তখন ভক্তদর্শকদের কাছে বিশেষ প্রতিপত্তি। বাবার সঙ্গ নিয়ে আছে অতএব তার মতামত ফেলনা নয়। তার মন্তব্য নতুন শ্মশানচারিণী কোনো মহাযোগিনী না হয়ে যায় না। নইলে এসেই বাবাকে চেনে কি করে, অমন করে হাসে কি করে, অমন সব কথা বলে কি করে?…এই ওই বাবার খেলা কি ওপর থেকে বাবার বাবার খেলা কে জানে! মায়ের দিকে তাকালে আমার তো হাড়ে কাপুনি ধরে গো বাবুরা!
তিন দিনের মধ্যেও ওই অদ্ভুত রমণী যখন মহাশ্মশান ছেড়ে নড়ল না সকলে ধরেই নিল এখানে থাকবে বলেই এসেছে। নতুন বাবা তাকে দেখে একটুও অবাক হয়নি, তার সম্পর্কে ভালো-মন্দ কোন কথাই বলেনি, তাকে থাকতেও বলেনি তাড়িয়েও দেয়নি। নতুন বাবা নির্বিকার। দুদুটো রাত যুবতী রমণীকে শ্মশানে খোলা আকাশের নাচে কাটাতে দেখে তৃতীয় রাতের দ্বিতীয় বামে নতুন বাবা আঙ্গুলের ইশারায় রাধুকে নিজের পর্ণকুটীর দেখিয়ে দিয়েছে অর্থাৎ একে ওইখানে গিয়ে থাকতে বলো।
বাবার ইঙ্গিত বুঝে মা-টি নাকি তার মুখের ওপরেই সেই প্রথম দিনের মতো খিল খিল করে হেসে উঠেছিল। তারপর সত্যিই বিনা দ্বিধায় বাবার কুটীরে গেছে রাধুর সঙ্গে। রাধুর জ্বালানী কাঠের আলোয় সকৌতুকে ঘরটা দেখেছে, তারপর বলেছে, খাসা ঘর, আমার জন্যেও এমনি একটা ঘর তুলে দিস তো। তারপর বলেছে, যা পালা এখন, দুরাত্তির না ঘুমিয়ে আমার বেজায় ঘুম পেয়েছিল সেটা তোর মহাদেও বাবা বুঝেছে দেখছি।
এই বিচিত্র রমণী যে মহাসাধিকা কোনো তাতে আর কারো সন্দেহ থাকল না। নইলে এই বয়সে এমন রূপ যৌবন নিয়ে সমস্ত ভয়-ডর বিসর্জন দিয়ে এভাবে কেউ শ্মশানবাসিনী হতে পারে?
গাঁয়ের মানুষেরা তাঁর নাম দিয়েছে বামাসাধিকা। শুনে এই রমণী নিজেই হেসে বাঁচে না। বলে, বামা তো বটে কিন্তু সাধিকা আবার কি রে মুখপোড়ারা!
ভক্তরা তোড়জোড় করে অশ্বথ গাছটার ওপাশে বামাসাধিকার পর্ণকুটীর তুলে দিয়েছে। সেই কুটীর দেখে সাধিকার আনন্দ ধরে না।