যুগের পর যুগ কেটে যাচ্ছে। আসন তেমনি ফাঁকা। ওটা এমনি ভীতির কারণ হয়েছে যে আর কোনো সাধু তেজ দেখিয়ে ওতে বসতে চেষ্টা করে না। খুব স্বাভাবিকভাবেই গাঁয়ের মানুষেরা ওই সিদ্ধাসনের কথা ভুলতে বসেছে।
হঠাৎ কাছে দূরের সব গায়ে বিষম চমক একদিন। সেই চমকের সাক্ষী শ্রী মুখোপাধ্যায়, তার সমসাময়িক আরো অনেক বৃদ্ধ। কাতারে কাতারে লোক ছুটল মহাশ্মশানের দিকে।
এত যুগ পরে মহাতান্ত্রিকের সেই সিদ্ধাসনে এসে বসেছে এক তরুণ সাধক। খুব বেশি হলে বছর উনিশ কুড়ি হবে বয়েস। একে একে তিনদিন অনাহারে ওই তন্ত্রাসনে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে। মাথা বিগডোয়নি এতটুকু, কোনোরকম তাপ উত্তাপের চিহ্ন মাত্র নেই।
সেই তরুণ তান্ত্রিককে প্রথম আবিষ্কার করেছে রাধু চণ্ডাল। তার শ্রেণীর মধ্যে সে তখন ডাকসাইটে যুবক। শ্মশানে শবদাহ করে বটে কিন্তু স্বজাতীয়দের সঙ্গে থাকে না। দূরের ওই পর্ণকুটীরে বাস তার। আড়ালে সকলে বলাবলি করে, স্বভাব চরিত্র। ভালো না, রাতে মাঝে মাঝে মেয়ে নিয়ে আসে আর ভয়ানক নেশা করে বলে স্বজনের সঙ্গে থাকে না। সামনে কেউ কিছু বলে না কারণ, লোকটার স্বভাব যেমন দুর্দান্ত তেমনি উগ্র।
অমাবস্যার গভীর রাত্রিতে সেই প্রথম এই তরুণ তান্ত্রিককে সহমুণ্ডীর আসনে তপোমগ্ন দেখেছে। নেশার ঘোরে কিছু দেখেছে কিনা নিজেরই সেই সন্দেহ হয়েছিল। পরপর তিনদিন তিনরাত ওই আসনে দেখেছে ওই বালক সাধুকে। ওই তিনদিন রাধু তার কাছ থেকে নড়েইনি বলতে গেলে। কাজেও যায়নি। কাণ্ড দেখে বুকের ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়েছে তার। নতুন বাবাকে একবার চোখ খুলে তাকাতে পর্যন্ত দেখেনি।
তারপর সে-ই অপরকে জানান দিয়েছে। দেখতে দেখতে নতুন বাবার কথা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।
গাঁয়ের মানুষ নতুন বাবা বলেই ডেকেছে সেই কিশোর তান্ত্রিককে। শ্রী মুখোপাধ্যায়ও স্বচক্ষে দেখেছেন তাকে। ভয়ানক কৃশ দেহ, অথচ তাই থেকে সত্যিই যেন আগুনের ছটা বেরুচ্ছে। একমাথা ঝাকড়া চুল। বয়েস কুড়ির মধ্যে মনে হয়েছে। কিন্তু তারই মধ্যে রটনা শুরু হয়ে গেছে, বয়সের গাছ-পাথর নেই নতুন বাবার–কারণ সহস্রমুণ্ডীর সেই মহাতান্ত্রিকই নব দেহ ধারণ করে মানুষের কল্যাণের জন্য আবার ওই আসনে এসে বসেছেন।
তাকে দেখে ভিতরটা খচখচ করেছিল শ্রী মুখোপাধ্যায়ের। অমন একটি নিষ্পাপ কচি মুখ আর বুঝি দেখেননি।…এ কোথা থেকে এলো এই ভীষণ শ্মশানে? কোথায় ছিল, কোন মায়ের বুক খালি করে এই পথে ছুটে বেরিয়েছে?
জবাব পাননি।
নতুন উত্তেজনায় দিন কাটতে লাগল। দিনের পর দিন মহাতান্ত্রিকের সহস্রমুণ্ডীর সিদ্ধাসনে নতুন বাবা সাধনায় নিবিষ্টচিত্তে বিকারশূন্য। একটি কথা বলে না, কারো দিকে তাকায় না। প্রায় অনাহারী।
ভক্ত-মানুষদের আনন্দ ধরে না। কত যুগের শূন্যতা ভরাট হয়ে গেছে। আপদে বিপদে তারা ছুটে যেতে পারবে কারো কাছে, কৃপার আশায় ধর্ণা দিতে পারবে। মহাতান্ত্রিকের সেই পর্ণকুটীরের স্থানেই নতুন বাবার কুটীর তৈরি করে দিল তারা। ভেট আসতে লাগল থরে থরে। ভক্তের সংখ্যা দলে দলে বাড়তে থাকল। নানা উৎসবে শ্মশান মেতে উঠল।
কিন্তু এত উৎসাহের এত মূলে যে নতুন বাবা তার কিন্তু কোন দিকে হুস নেই। অপার্থিব সাধনায় নিয়ত মগ্ন। সহস্রমুণ্ডীর আসনে উপবিষ্ট দিন-রাতের বেশির ভাগ সময়। ভেট ফেলে ছড়িয়ে একাকার করে। নিতান্ত খেয়াল হলে কিছু মুখে দেয়। আর নিতান্তই খেয়াল হলে কুটীরে এসে রাত্রি যাপন করে। নয়তো আসনে কাটায়, অথবা শ্মশানেই গড়াগড়ি দেয়।
এই নতুন বাবার প্রথম কৃপাধন্য রাধু-চণ্ডাল। ওকেই প্রথম চোখ মেলে দেখেছিল, আর ওর সঙ্গেই প্রথম বাক্যালাপ। প্রায়ই আর নিজের ডেরার যেত না রাধু। সমস্ত রাত কাছাকাছি বসে থাকত। নির্নিমেষে দেখত। ঘুমিয়ে পড়লে চমকে জেগে উঠে আবার দেখত। ওর ধারণা নতুন বাবা ছদ্মবেশী মহাদেব ছাড়া আর কেউ নয়।
এমনি একটা রাতের তখন তিন প্রহর হবে বোধহয়। রাধু দেখে নতুন বাবা। ওর দিকে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে আছে। শিউরে উঠে রাধু দুই হাত জোড় করল।
রাধু অবাক, নতুন বাবা হাসছে ওর দিকে চেয়ে!
–না খেয়ে এখানে পড়ে আছিস কেন?
সেই কণ্ঠস্বর কানে যেতে রাধুর সর্বাঙ্গে শিহরণ। জবাব দিয়ে বসল, তুমি তো কদিনের মধ্যে খাওনি।
নতুন বাবা আরো হাসল, বলল, তুই ব্যাটা পাজীর শিরোমণি। বলে সামনের ছড়ানো খাবার তুলে নিয়ে ওর হাতে দিল, নে খা–।
নিজেও খেল।
আনন্দে আত্মহারা রাধু বলেছে, তোমাকে আমি ঠিক চিনলাম গো, তুমি মহাদেও!
আবার সেই হাসি।–তা চিনবি না, তুই যে আমার নন্দীভৃঙ্গীর একজন…তুই ভৃঙ্গী।
সেই থেকে রাধু চণ্ডাল রাধু ভৃঙ্গী! আর তারপর থেকে ও যেন নতুন বাবাকে খাওয়াবার একটা ফিকিরও পেয়ে গেল। বাবা দুদিন না খেলেই ও নিজেও না খেয়ে বসে থাকে। বাবা রেগে যায় আবার হাসেও। সেই হাসি দেখলে মনে হয় তিন বছরের একটা কচি ছেলে হাসছে। ৬৮৪
তাকে শ্মশানের মাটিতে গড়াতে দেখলে কুটীরে নিয়ে যাবার জন্য রাধুর ভিতরটা ছটফট করতে থাকে। কিন্তু খাওয়াবার মতো সে-রকম কোনো বুদ্ধি মাথায় আসে না।
ছমাসের মধ্যে মহাশ্মশানে দ্বিতীয় চমক আবার।
দ্বিধা-দ্বিপ্রহর সেদিন। মাথার ওপর সূর্যটা আগুনের গোলার মতো জ্বলছে। পা ফেলা যায় না শ্মশানের মাটি এমন তপ্ত। শ্মশান খাঁ-খাঁ করছে, রোদ চড়ার আগে ভক্তরা বিদায় নিয়ে গেছে। সকাল থেকে সেদিন আর নতুন বাবাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখেনি কেউ। সহস্রমুণ্ডীর আসনে গত রাত্রি থেকে সমাসীন, তপোমগ্ন।