কিন্তু আজও মহাশ্মশান বলতে এটাই।
নদীর ধার ছেড়ে খানিকটা ভিতরের দিক ধরে এগিয়ে চলেছি। কোথাও কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই। এমন কি একটা শেয়াল কুকুরও চোখে পড়ল না। তাই আপন অস্তিত্ব এখানে যেন বড় বেখাপ্পা রকমের সচেতন!
অনেকটা এগোবার পর একটা ছোট্ট জীর্ণ মন্দিরের কাঠামো চোখে পড়ল। আর ঠিক তখনি আমার সমস্ত তন্ময়তা একাগ্র হয়ে উঠল।…মন্দিরের থেকে পঞ্চাশ গজের মধ্যে দুটো পর্ণকুটীরের ধ্বংসাবশেষ এখনো দাঁড়িয়ে আছে। ধ্বংসাবশেষ বলতে কতগুলো করে পোকায়-খাওয়া কাঠের থাম আর মাটির ভিত। মাথার ওপর চালা। নেই একটারও। এতকালের ঝড়ে জলে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
দুটো কুটীরের মাঝে চল্লিশ গজের মতো ফারাক। ওই দুটো ঘরের কাঠামোর মাঝে আজও সেই অশ্বথ গাছটা দাঁড়িয়ে–যেটার দিকে তাকিয়ে রাধু ভৃঙ্গী অট্টহাসি হেসে লোকের হাড়-পাঁজরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিল।
ওই দিকেই আরো কম করে একশ গজ তফাতে আর একটা কুটীর। সেই তৃতীয় কুটীরও জীর্ণ কিন্তু এ-দুটোর মতো ভগ্নদশা নয়। মাথার ওপর চাল আছে। আমার মন বলে দিল ওটাই লক্ষ্য। ওখানে রাধু ভূঙ্গী থাকে।…আগেও থাকত, এখনো থাকে।
কিন্তু এখানে আসার পর আমার যেন তাড়া নেই আর। হাতে যেন অঢেল সময়। স্থান মাহাত্ম কিনা জানি না।…একদিন এখানে লোক এসে আর নড়তে চাইত না। অনেকে রাতের পর রাত হত্যা দিয়ে পড়েও থাকত। পায়ে পায়ে আমি ওই ভগ্নজীর্ণ মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কিন্তু মন্দির বা মন্দিরের বিগ্রহ আমার চোখ টানছে না। উৎসুক চোখে খানিক দূরের বাঁধানো বেদীটার দিকে তাকালাম। পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলাম।…না বেদীর ওপর বাঘের বা হরিণের কোনো চামড়ার আসন বিছানো নেই। থাকার কথাও নয়।
কারণ ওই বেদীটাই আসন। মহাতান্ত্রিক সাধকের সহস্রমুণ্ডীর আসন।
..আচ্ছা, সোজা গিয়ে যদি ওটার ওপর বসে পড়ি? কি হবে? কি বিপর্যয় ঘটবে? …ভিতরটা কি সত্যিই জ্বলে যাবে? পুড়ে যাবে? জ্বলতে জ্বলতে পুড়তে পুড়তে সত্যিই কি মরণ ছোটা ছুটতে হবে আমাকেও?
যাক, আমি এখানে নাটক করতে আসিনি, চোখের ভোজ আর মনের ভোজের। এক অলক্ষ্য আমন্ত্রণ আমাকে এখানে টেনে এনেছে।
..সেই মহাতান্ত্রিক সাধক এইখানেই প্রথম সাধনায় বসেছিলেন। লোকে দূর থেকে দেখত তাঁকে, কাছে আসার সাহস ছিল না। প্রাণের দায়ে কেউ যদি কাছে আসত। চোখের আগুনে তিনি জ্যান্ত ভস্ম করতে চাইতেন তাকে। তাতেও কাজ না হলে চিমটে নিয়ে তাড়া করতেন। সে-রকম দরকার কমই হত, ভক্তর প্রাণ তার আগেই খাঁচা-ছাড়া হত প্রায়। কিন্তু মাঝেমধ্যে মহাতান্ত্রিক নিজেই আসতেন নদীর ধারে শবদাহ। দেখতেন, সকৌতুকে মৃতের আত্মীয় পরিজনদের কান্নাকাটি দেখতেন। একবার এক অভাবিত কাণ্ড ঘটে গেল। মায়ের একমাত্র সন্তান বছর দশেকের এক ছেলে মারা গেছে। সেই ছেলের মা পাগলিনীর মতো ছুটে এসেছে। কেউ তাকে ধরে রাখতে পারছে না। শ্মশানে এসেও সে ছেলেকে আঁকড়ে ধরে আছে, কিছুতে নিতে দেবে না। আত্মীয় পরিজনেরা নিরুপায় হয়েই দেহ ছিনিয়ে নেবার উপক্রম করছে।
অনতিদূরে মহাতান্ত্রিক দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। হঠাৎ চিৎকার করতে করতে ছুটে এলেন। আত্মীয় পরিজনদের ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলেন। তারপর গর্জন, ছেলেটার দেহে প্রাণ আছে এখনো, পাষণ্ডরা তাকে চিতায় দিতে যাচ্ছিস! তোরা যা, তোরা চিতায় উঠগে যা!
…আধ ঘণ্টার মধ্যেই সকলে দেখল সেই ছেলের দেহে প্রাণ আছে বটে! এই ঘটনার সাক্ষী কেউ নেই, কারণ এই মহাশ্মশানে মহাতান্ত্রিকের পদার্পণ দেড়শ বছর আগের কথা কি তারও বেশি কেউ বলতে পারে না। কিন্তু সদ্যদেখা কিছুর মতই ওই সাধুর কথা আর তার অলৌকিক ক্রিয়াকলাপের কথা আজও তাজা আছে।
যাক, তারপর থেকেই সাধুর নির্জন বাস ঘুচে গেল প্রায়। তার বুকের তলায় যে স্নেহমায়া মমতার ফল্পধারা বইছে এটা গ্রামবাসীরা টের পেয়ে গেল। এরপর জ্বলন্ত চেলাকাঠ নিয়ে তাড়া করেও ভক্ত হটানো যেত না।
তাদের ভিড় বাড়তেই থাকল, ভক্তিবাড়তেই থাকল। দূর দূরান্তে সাধুর মাহাত্মের কথা ছড়াতে থাকল। অলৌকিক উপায়ে সাধু মানুষের ব্যাধি দূর করছেন, দুর্দৈব খণ্ডন করছেন। সাধুর কৃপায় বাঁজা মেয়েমানুষও সন্তানবতী হয়েছে। জমির অজন্মা ঘুচে গিয়ে ফসলের জোয়ার এসেছে–এমন কত তাজ্জব কাণ্ড। সাধু মুশকিলআসান।
মুগ্ধ ভক্তের সংখ্যা বাড়ছেই, বাড়ছেই। তারা সাধারণ লোক, কাছের দূরের দশ গাঁয়ের মানুষ। তাদের উৎসাহে বিপুল টাকা সংগ্রহ হল, শ্মশানে ওই কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা হল। আর প্রতিষ্ঠা হল মহাতান্ত্রিকের ওই সহস্র মুণ্ডীর আসন। তার বাসের পর্ণকুটীরও তৈরি করে দিল তারা। বছর ঘুরেছে অনেকগুলো। মহাতান্ত্রিক ওই সহস্রমুণ্ডীর আসনে বসেই দেহরক্ষা করেছেন।
এরপর শ্মশান থাকল, মন্দির থাকল, ভক্তদের আনাগোনাও অব্যাহত থাকল কিছুকাল। কিন্তু বাবার সহস্রমুণ্ডীর আসন শূন্য। আর সেই শূন্যতা সমস্ত মানুষের। বুকের তলায়। কে বসবে ওই আসনে? বিভিন্ন জায়গা থেকে সাধু সন্ন্যাসীরা এসেছে, লোভে পড়ে বাবার আসনে বসেছে। কিন্তু দুদিনও টিকতে পারেনি। আসন ছেড়ে উঠে পাগলের মতো যেন মরণ ছোটা ছুটেছে তারা। আর আর্তনাদ-জ্বলে গেলাম, জ্বলে গেলাম–পুড়ে গেলাম! সেই সব সাধুদের গাঁয়ের কোথাও দেখা যেত না।