দুয়ে দুয়ে যোগ করলে যেমন চার হয়, মহাশ্মশানের ঘটনা যারা দেখেছেন বা শুনেছেন তারা একটা সহজ যোগসাধন করেছেন আর তারপর তেমনি সহজ একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। কিন্তু শ্রী মুখোপাধ্যায় তাদের থেকে একটু বেশি জেনেছিলেন, একটু বেশি বুঝেও ছিলেন। কারণ সেই তরুণ বয়সে ওই মহাশ্মশানে তিনি প্রায়ই যেতেন আর তার ফলে সেখানকার একটি বিশেষ লোকের সঙ্গে তার হৃদ্যতা হয়েছিল।
…সেই লোকের নাম রাধু ভৃঙ্গী। শ্মশানে বাস তার, শবদাহ করা তার কাজ। ওই মহাশ্মশানে আর শবদাহ হয় না দীর্ঘ দিন হয়ে গেছে। কিন্তু রাধু ভৃঙ্গী আজও স্থান ত্যাগ করেনি, সেখানেই ডেরা বেঁধে আছে। সমস্ত ঘটনার একমাত্র সাক্ষী সে। আজও লোকটা সেই দিনের মতই স্মৃতির যন্ত্রণায় স্তব্ধ শোকাহত কিনা শ্রী মুখোপাধ্যায়। জানেন না।
.সেদিনের সেই ঘটনা আগুনের মতো এখানে ছড়িয়ে পড়তে উনিও মহাশ্মশানে ছুটে গেছলেন। অবশ্য গাঁয়ে ছিলেন না বলে তাঁর যেতে একটু দেরি হয়েছিল, তার পৌঁছুতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছিল।…কিন্তু লোকটা ওই রাধু ভৃঙ্গী তার সেই পাথরের মতো বিশাল কুচকুচে কালো শরীরটা টান করে, কোমরে দুই হাত রেখে তার বাবার ডেরা আর মায়ের ডেরার মাঝের অশ্বত্থ গাছটার দিকে ঘাড় উঁচিয়ে চেয়ে হা-হা-হা-হা শব্দে হাসছিল। অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে এমন হাসি। ওর সেই হাসি নাকি সকালে আরো বেশি শোনা গেছে। সকলে ধরে নিয়েছিল লোকটা পাগল হয়ে গেল।
…শ্রী মুখোপাধ্যায় ওকে হাসতে যেমন দেখেছেন, দুই এক দিনের মধ্যে আবার স্তব্ধও হতে দেখেছেন তিনি। ওর মুখ থেকেই অসংলগ্ন এমন কিছু কিছু উক্তি শুনেছেন তিনি যে সমস্ত ব্যাপারটার কার্যকারণ তিনি অন্যভাবে দেখতে চেষ্টা করেছেন। আর তার ফলে, প্রতিশোধের নেশা রক্তে মিশলে প্রাণপাত চেষ্টা করেও তার থেকে উত্তীর্ণ হওয়া যায় কিনা সেই সংশয় আজও কাটেনি তার।
মোটামুটি ঘটনাটা শুনে আমিও স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম খানিক! কি ভেবে হঠাৎ উনি মন্তব্য করলেন, অনুমান যা-ই করি না কেন, আমার এখনো কিছু জানতে বাকি বুঝলে…ওই রাধু ব্যাটার সঙ্গেও কোনো একটা মেয়ে-টেয়ের লটঘট ব্যাপার ছিল কিছু। বুঝলে..কিন্তু ওই সাংঘাতিক ঘটনার সঙ্গে তার কি সম্পর্ক সেটা আজও জানি না।
উৎসুক মুখে জিজ্ঞাসা করলাম, এ-রকম ভাবছেন কেন?
-লোকটাকে কঠিন পাথর বনে যেতে দেখে একদিন সান্ত্বনা দেবার জন্য বলেছিলাম, তুই তো মরদ আছিস রে, শক্ত হয়ে উঠে দাঁড়া–! ও বিড়বিড় করে জবাব দিল, শক্ত তো আছি, কিন্তুক ভাবছি…। জিজ্ঞেস করলাম, কি ভাবছিস? ও ঘোলাটে চোখে আমার দিকে চেয়ে রইল, অনেকক্ষণ পর্যন্ত পলক পড়ে না, শেষে তেমনি বিড়বিড় করে বলল, মুন্নিকে আখুন কুথা পাই? আমি অবাক হয়ে বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলাম, মুন্নি কে? যত শুধোই একটা যন্ত্রণা যেন ওর সেই গোল গোল কালো চোখ দিয়ে ঠেলে বেরুতে থাকে–তারপর রেগে গিয়ে আমাকে তেড়ে মারতে এলো প্রায়। যে কদিন মুন্নির কথা জিজ্ঞেস করেছি, ও ক্ষেপে উঠেছে, যাচ্ছেতাই গালাগালি করে আমাকে তাড়াতে চেয়েছে। শেষে শাসিয়েই দিল, ফের ওর কাছে এসে ঝামেলা করলে ও চেলা-কাঠ দিয়ে মেরে আমাকে জন্মের মতো ঠাণ্ডা করে দেবে।…এর পরেও গেছি অবশ্য, শেষ গেছি বছর দশেক আগে, তখন অনেক ঠাণ্ডা মানুষ, গোড়ায় ভালো করে চিনতেই পারেনি, তারপর বলেছে, বাবার আসনটা খালি পড়ে থাকল, কেউ আলো না, কেউ বসল না, উ আসন খালিই থাকল রে বাবু…।
.
এ পথে পা বাড়াতে পেরেছি আরও দিন চারেক পরে। আমাকে নাছোড়বান্দা দেখে বাড়ীর কর্তাটি শেষে সঙ্গে লোক দিতে চাইলেন। কিন্তু আমার তাতে প্রবল আপতি। এতদিনে আমি এপারে অনেকটা পরিচিতি লাভ করেছি। তাছাড়া যে এলাকাটি আমার লক্ষ্য সেই জনমানবশূন্যস্থানে লোক-বসতির জটিল মানসিকতার কোনো ঢেউ গড়ায়নি। অতএব শ্রী মুখোপাধ্যায়ের যে দুশ্চিন্তার খুব একটা কারণ নেই সেটা তিনি নিজেও জানেন।
চলেছি…।
নির্জন পথে নিঃসঙ্গ চলার একটা আকর্ষণ আছে। দুই চোখ ভরাট করে করে চলার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে পাবার আনন্দ আমার অনেকখানি রপ্ত। এক কথায় ব-কিছুর মধ্যে ছড়িয়ে থেকেও আমি নামে ছোট গণ্ডীর মানুষটাকে ছাড়িয়ে যাওয়া।
উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম যেদিকে চোখ যায়, যতদূর চোখ যায় কেবল ধান। ক্ষেত আর ধান ক্ষেত। চারদিক থেকে যেন দিগন্ত ছুঁয়ে আছে। ধান কেটে নেওয়ার ফলে ধু-ধু রিক্ত দশা। তারই ভিতর দিয়ে আঁকা-বাঁকা পায়ে চলা সরু পথ ধরে চলেছি। শীতকাল না হলে আলাদা-গোখরার ভয়ে অনেক ঘোরা-রাস্ত ধরতে হত। জায়গায় জায়গায় ছোট ছোট ঝোঁপ ঝাড় জঙ্গল। ধান ক্ষেতের সবুজের মিতালী খুইয়ে ওগুলো যেন নিঃসঙ্গ হয়ে আছে। উত্তর দিকে সরু একটা নদী। নদীটা হেজে মজে গেছে। শুনেছি বর্ষায় জল এলে এই নদীই চারদিকের চাষের জমি ভাসিয়ে দেয়। চাষীরা নাকি উপকারী বন্ধুর মতো ভাবে এই নদীটাকে। এটা আছে বলেই এখানে চাষ আবাদ আছে।
শুকনো নদী হেঁটে পার হলাম। মহাশ্মশানে পড়ল।
এই শ্মশানের পরিধি ভিতরে বহু দূর পর্যন্ত চলে গেছে। শবদাহ তো সর্বদাই। নদীর ধারে হয়ে থাকে, শ্মশান ভিতরের দিকে বিস্তৃত হল কেমন করে?
…হল, কারণ এক মহাতান্ত্রিক সাধকের পদার্পণ ঘটেছিল এখানে। তিনি জনসমাগমের ধারে কাছে থাকতে চাননি। ভিতরের দিকে চলে গিয়ে মনের মত নির্জন সাধনার জায়গা বেছে নিয়েছিলেন। লোকে বলাবলি করেছে দীর্ঘ অনুসন্ধানের পরে মহাতান্ত্রিক নাকি তার সাধনার স্থান খুঁজে পেয়েছেন। হাজার বছরের পুরনো এই মহাশ্মশান। কিছুকাল আগে পর্যন্ত এইখানেই বহু দূরের মানুষেরও দাহ-কর্ম সম্পন্ন। হত। এখন গাঁয়ের লাগোয়া শ্মশান হয়েছে, এখানে আর শবদাহ হয় না।