শ্রী মুখোপাধ্যায় এই বর্ধিষ্ণু গাঁয়ের এক রক্ষণশীল নামী পরিবারের মানুষ। তার পিতৃপুরুষেরা নিষ্ঠাসহকারে ধর্মচর্চা করেছেন আবার নিষ্ঠাসহকারে নিজেদের জমিজমাও রক্ষা করে গেছেন। শ্রী মুখোপাধ্যায়ের আমলে সেই ভিটেমাটি জমি-জমার পরিধি আরো বেড়েছে।
বছর দুই আগেও কলকাতার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। মাসে দুই একবার আসতেনই। নিজের বইপত্রের তদারকে আসতে হত, তত্ত্বতথ্যের গ্রন্থাদি ঘাঁটাঘাঁটির তাগিদেও আসার দরকার হত। তাছাড়া স্নেহবদ্ধ বহু শুভার্থীজনের তাগিদ তো ছিলই। বয়সের দরুন যাতায়াত ক্রমশ কমেছে। বছরখানেক হল আসা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। আমি তার দীর্ঘদিনের স্নেহের পাত্র। ওরকম খাঁটি স্নেহ এই যুগে বিরল। চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল। শেষ চিঠিতে তিনি লিখেছেন, দেহ-যন্ত্র ঢিলে-ঢালা হয়ে এসেছে, আর ছোটাছুটি পোষায় না, তাছাড়া যে দিন পড়েছে মনের অবস্থাও সর্বদা বিষ-বিষ। তোমাদের দেখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু নিজে না ছুটলে তো তোমাদের দেখা পাওয়া ভার।
এই চিঠিও মাস ছয়েক আগের।
…স্টেশনের নামটা চোখে পড়া মাত্র এই মানুষই দুখানা অদৃশ্য হাত বাড়িয়ে আমাকে যেন হিড়হিড় করে টেনে নামিয়েছেন।
দেয়াল-ঘেরা অনেকটা জমির মধ্যে দালান-কোঠা। টিনের গেট সরিয়ে ভিতরে ঢুকলে মাঝের রাস্তাটা চক্রাকারে বেঁকে দালানের সিঁড়ির মুখে ঠেকেছে। এই পথটুকুতে আলো নেই বটে; তবু চাঁদের আলোয় বোঝা যায় রাস্তার একদিকে ফুলের বাগান অন্যদিকে সবজি অথবা ফলের ক্ষেত। টিনের গেট সরানোর সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে। গোলাপের গন্ধের ছড়াছড়ি।
আমাকে দেখামাত্র বৃদ্ধের মুখের সেই বিস্ময় আর খুশির কারুকার্য ভুলব না। চোখের সামনে দেখেও তিনি যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না।
শ্রী মুখোপাধ্যায়কে এত কাছে আর এমন ঢালা অবকাশের মধ্যে আর কখনো পাইনি। নিঃসঙ্গ জীবনে আমি যেন তার পরম লোভনীয় কেউ একজন। তার গৃহিণী সর্বদা পুজো আর্চা নিয়ে থাকেন আর তিনি নিজের পুঁথিপত্র নিয়ে। তাদের দুটি ছেলেই কৃতী এবং বাইরে হোমরাচোমরা চাকুরে। এখানে তার জ্ঞাতিরাই আছে জনাকতক, আর আশপাশে বয়স্ক ভক্ত আছে কিছু। এখানে আসার পরদিন সকালেই নিজের হাতে তিনি আমার বাড়িতে চিঠি লিখে জানান দিয়েছেন আমি এখানে আছি এবং দিন-কতক থাকব।
প্রথম দিন কয়েক একলা আমাকে কোথাও যেতে দেননি ভদ্রলোক। নিজে সঙ্গে নিয়ে ঘুরেছেন আর দূরে বেড়াবার ইচ্ছে দেখলে সাইকেল রিক্সা ডাকিয়ে আগের ভাগে তিনি ওতে চেপে বসেছেন। নিজেই আবার কৈফিয়ত করেছেন, তুমি অচেনা মানুষ, দিন-কাল ভালো নয় হে…
তার ভয়টা অনুমান করতে পারি। খবরের কাগজে ইদানীং এ অঞ্চলের আপদ বিপদ সম্পর্কে কিছু লেখালিখি চলেছে কলকাতা থাকতেই লক্ষ্য করেছি।
সন্ধ্যে না হতে বাইরের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ। তখন ঘরে বসে কেবল গল্প আর গল্প। গোড়ায় গোড়ায় রাত বারোটা একটা বেজে গেছে। আমি বলেছি, আপনার শরীর খারাপ হবে যে, শুতে যান–
উনি বলেন, হুঃ তোমাদের আজকালকার ছেলে ছোকরার স্ত্রীর পেয়েছ!
সন্ধ্যার আসরে গৃহস্বামীর জনাকতক ভক্ত এসে যোগ দেন। একটা নৈমিত্তিক ব্যাপার। এখানকার মানুষদের সুখ সুবিধে আপদ বিপদের কথাই বেশি হয়। বর্তমানের নানা সমস্যা আর সেই সমস্যার দুর্নিরীক্ষ্য সমাধান নিয়ে মাথা ঘামান। আমি নীরব শ্রোতা।
খাওয়া-দাওয়ার পর সেদিন দুজনে মুখোমুখি গল্প করতে বসে জিজ্ঞাসা করলাম, দিনকালের হাওয়া তো এই, আপনার যে এত জমি-জমা, লোকের চোখ টাটায় না?
শ্রী মুখোপাধ্যায় হেসে জবাব দিলেন, টাটানোটাই তো স্বাভাবিক, তবে আমি শুরু থেকেই কিছুটা ভাগ করে ভোগ করে আসছি বলে এখনো অনেকে সদয় আমার ওপর।…এটুকুও বেশি দিন থাকবে না, আর খারাপ দিন আসছেই তার কোন ভুল নেই।
-আপনার ভয় করে না?
-ভয় করে কি লাভ, তবে অস্বস্তি হয় বটে…এত বছরের লোভের সংস্কার চট করে কাটিয়ে ওঠা তো সহজ কথা নয় রে ভাই, তা যা খাবার ভাবনা একটু থেকেই যায়।
কারো প্রতি অভিযোগ নেই, নিজে সব ছেড়েছুঁড়ে দিতে পারছেন না সেটাই যেন সমস্যা। একটু বাদে অনেকটা নিজের মনেই তিনি যে কথাগুলো বললেন কান পেতে শোনার মতই। বললেন, ইংরেজ শাসন ফুরোবার ঢের আগে থেকেই এ-দেশের মানুষ তার নীচের মানুষের ওপর অত্যাচার চালিয়ে এসেছে। আর পঁচিশ বছরের এই স্বাধীনতার পরেও তার রকমফের হয়নি। নীচের মানুষ আর কতকাল নীচে পড়ে মার খাবে রে ভাই…এখন আমরা হায় হায় করলে কি হবে, যা হবার তাই হচ্ছে।
কথায় কথায় নিজের দেখা কিছু কিছু অত্যাচারের গল্প করলেন তিনি, প্রতিশোধের নেশা কেমন রক্তে এসে যায় সেটাই বক্তব্য।
এই প্রসঙ্গে হঠাৎ এমন একটা গল্প মনে পড়ল তার যার সামান্য কাঠামোটা শুনে আমি নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলাম। গল্পে গল্পে তখন অবশ্য আমরা দিন-কালের সমস্যার প্রসঙ্গ থেকে অনেকটাই সরে এসেছিলাম। গল্পই করছিলাম আর গল্পই করছিলাম আর গল্পই শুনছিলাম। এরই মধ্যে তার ওই শোনা ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। শোনা ঘটনার পরিণামটা যে যথার্থ, তাতে কারো সংশয় নেই। কারণ শেষের ওই মর্মান্তিক ঘটনার সেই রঙ্গমঞ্চ এখান থেকে মাত্র মাইল কয়েক দূরের মহাশ্মশান। ..দীর্ঘকাল আগের সেই ব্যাপারটা শোনার পর বিভ্রান্ত হতচকিত হয়ে গেছল এখানকার মানুষ। পরে বুকের তলায় কাপুনি ধরেছিল সকলের। সে-দিনের অনেক বৃদ্ধ আজও বেঁচে আছে, রোমহর্ষক একটা দৃশ্য অনেকে চাক্ষুষ দেখেও এসেছে। তাই ব্যাপারটা পুরনো হয়নি আজও…মহাশ্মশানের কাঁপালিক বাবার আসন শূন্য পড়ে আছে এখনো, মাথা ঘামাক আর না ঘামাক এ-গল্প অন্তত এখানকার ছেলে-ছোকরারাও জানে।