…কিন্তু রাধু অসহায়, একবার প্রবৃত্তির দাস হলে তার বুঝি আর অব্যাহতি নেই। আবারও গেছে মুন্নার কাছে। অনেক দিন পরে গেছে। মুন্না ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে আবার কেঁদেও ভাসিয়েছে। আগে আর কখনো কাঁদেনি মুন্না।
পরদিন নয়া বাবার সামনে আসতেই বাবা আঙ্গুলের ইশারায় ওকে সামনে থেকে চলে যেতে হুকুম করেছে। বামাসাধিকা তখন বাবার সামনে বসে। সে-ও গম্ভার। চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে রাধু সরে এসেছে।
বিকেলে বাবার সামনে মা-ই ওকে ডেকে পাঠালো। কাছে যেতে ধমকে উঠল, বলি কোথায় মরে পড়েছিলি সমস্ত দিন-কাঠ নেই, বলি এ-সব কি আমি বয়ে নিয়ে আসব!
রাধু পড়িমরি করে ছুটেছে সব সংগ্রহ করতে। কিন্তু আশ্চর্য, নিয়ে এসে দেখে কাঠ ধুনো সবই আছে–আর মায়েরও খুশি-খুশি মুখ।
সেই থেকে রাধু বুঝে নিয়েছে মায়ের অন্তত ওর ওপর রাগের লেশমাত্র নেই। আর পরে ক্রমশ এও অনুভব করেছে, ওকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে নয়া বাবার ঝগড়াঝাটিও হয় মাঝে মাঝে। ঝগড়ার হেতু যে মুন্না তাতে আর সন্দেহ কি!
..সেদিন রাতের শেষ যামে মুন্নার ডেরা থেকে ফিরে রাধু সকালে আর নয়া বাবার আসনের দিকে যায়নি। ভয়ে ভয়ে নিজের ডেরাতেই বসে আছে। এ-রকম। আরো দুই একবার হয়েছে। পরে নয়া বাবার আর সে-রকম চাউনি দেখেনি। ওর ধারণা মা-ই নয়া বাবার মাথা ঠাণ্ডা করে ওর ফাড়া কাটিয়ে দেয়। কিন্তু এবারে আর তা হল না। একটু বেলা হতে মা এলো। গগনে মুখ। ঝাঁঝিয়ে বলল, তোর নয়া বাবা যে এখান থেকে তাড়াবেই তোকে ঠিক করেছে সে খেয়াল আছে? এবারে যেখানে খুশি গিয়ে মর গে যা, আমি আর কিছুতে নেই।
সমস্ত পৃথিবীটা বুঝি রাধুর চোখের সামনে বনবন করে ঘুরে গেল। অন্ধকার দেখছে। মা ঝলমল পা ফেলে চলে যাচ্ছে।
রাধু ছুটে গিয়ে তার দুটো পা আঁকড়ে ধরে মাটিতে শুয়ে পড়ল।
–ছাড়! ছাড় বলছি, পাজি হতচ্ছাড়া! চুলোয় যা, চুলোয় যা।
রাধু পা আঁকড়ে ধরে পড়েই রইল। নিশ্চল মুহূর্ত গোটাকতক।
-পা ছাড়। এই কণ্ঠস্বর সম্পূর্ণ আলাদা। রাধু পা ছেড়ে উঠে বসল।
-যা, ঘরে যা। বিকেলে আসিস।
.
ছমাস কেটেছে তারপর। রাধুর সংযমে চিড় খায়নি আর। প্রবৃত্তির সেই অন্ধ আবেগের পাল্লায় পড়ার আগেই মদে ডুবেছে। বাবার বিরূপ্ৰভাজন আর সে হবে না–তার আগে শরীরের ক্ষুধা টুটি টিপে শেষ করবে ও। ভিতরটা এখনো ছটফট করে এক একসময়। তখন সক্কলের ওপর রাগ হয়–নিজের ওপরে, মুন্নার ওপরে, মায়ের ওপর, ওই নয়া বাবার ওপর–দুনিয়ার সক্কলের ওপর। মদে চুর হয়ে হয়ে ফাড়াকেটে যাবার পর মুখে হাসি ফোটে, নিজের ওপর আস্থা ফেরে।
..তারপর সেই এক ভয়াল রাত। প্রথম প্রহর হবে সেটা। মহাশ্মশান নিস্তব্ধ। নয়া বাবা কালীমন্দিরের সামনে বসে। অদূরে মা-ও বসে। তার হাত তিনেক দূরে রাধুও বসে ঝিমুচ্ছে।
হঠাৎ আঁতকে উঠল সে। ঠিক দেখছে কি স্বপ্ন দেখছে ভেবে না পেয়ে দুচোখ রগড়ে নিল। যা দেখছে সত্যি, না রাধুর মাথা খারাপ হয়ে গেল? ফ্যালফ্যাল করে বাবার দিকে তাকালো, তারপর মায়ের দিকে। তারাও অবাক বিস্ময়ে একই দৃশ্য দেখছে।
কোমরে দুহাত তুলে বাবার ঠিক দশ গজ দূরে মুন্না দাঁড়িয়ে আছে। দৃপ্ত উদ্ধত ফণা তুলে শত্রুকে দেখছে যেন সাপিনী। বাবাকেই দেখছে, বাবার দিকেই চেয়ে আছে, দুচোখ জ্বলছে।
রাধু নির্বাক, বিমূঢ়। গলা কাঠ, জ্ঞান বিলুপ্ত যেন।
তেমনি জ্বলন্ত চোখে একবার সকলকেই দেখে নিল মুন্না। তারপর বাবার দিকে ফিরল আবার। হিসহিস করে বলল, তুমি এখানে এসেছ কেন? পাহাড়ে যাও, জঙ্গলে যাও! এখানে এসে মেয়ে মানুষের মরদ কেড়েছ-তোমার পুণ্যি হবে? তোমার পাপ লাগবে না?
ওরা তিনজন তেমনি নির্বাক, তেমনি নিশ্চল।
যেমন আচমকা এসেছিল তেমনি আচমকা অন্ধকারে মিশে গেল মুন্না। একটা অদ্ভুত মোহ ভেঙে সজাগ হল যেন রাধু ভৃঙ্গী।
থমথমে মুখে নয়া বাবা উঠে নিজের কুটীরের দিকে চলে গেল।
মায়ের মুখভাব এখন শান্ত, নির্লিপ্ত।
রাধু উঠল। ক্লান্ত শরীরটা টেনে হিঁচড়ে ডেরার দিকে নিয়ে চলল। ঘরের কাছাকাছি এসে হুশ ফিরল আবার। ঘরে কুপী জ্বলছে।…আশ্চর্য, এ-রকম ভুল ওর বড় একটা হয় না। কুপী জ্বেলেই চলে গেছল।
ঘরে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত স্নায়ু লণ্ডভণ্ড করে দেবার মতই বিষম চমক আবার। সামনে মুন্না দাঁড়িয়ে। দুহাত কোমরে তেমনি। কিন্তু হাসছে এখন। ওর চোখ হাসছে, মুখ হাসছে, সর্ব অঙ্গে হাসির বিদ্যুৎ ঝলসাচ্ছে যেন। হাসির দমকে ওর ভরা। বুক ফুলেফুলে উঠছে, সাদা দাঁত ঝকমক করছে।
…রাধু কি ওই অমোঘ ইচ্ছার সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে না হাতের কাছে কিছু একটা। ধরে ভেসে ওঠার শেষ চেষ্টা করছে?…হাতে ঠেকল কিছু। শেয়াল আর শুয়োর তাড়ানোর ডাণ্ডা।
তারপর কি হলো রাধু জানে না।
তীব্র তীক্ষ্ণ সত্তা থেঁতলানো আর্তনাদে শ্মশানের স্তব্ধতা খান খান করে দিয়ে। বাতাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কাঁপুনি ধরিয়ে দিলছুটন্ত আর্তনাদ-নাড়ি-ছেঁড়া আর্তনাদ করতে করতে মরণ-ছোটা ছুটছে।
স্থাণুর মতো কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল রাধু জানে না। ঘরে এসে আবার কে দাঁড়াল। বামাসাধিকা। ঘোলাটে চোখে রাধু তাকালো তার দিকে।
সামনের লোহার ডাণ্ডাটা দেখল বামাসাধিকা। শিউরে উঠল একবার। এভাবে মারলি? এ-ভাবে মেরে শেষ করলি?
ঘোলাটে চোখে রাধু চেয়েই আছে।