শেষে দূর থেকে এক বড় গুণীন এলো। বলা বাহুল্য এটা রাধুর কারসাজি। আসলে সে গুণীন-টুনিন কিছুই নয়। রাধুর মোটা টাকা খেয়ে সে গুণীন হয়ে এসেছে। রোগের ফয়েসলা করে দিলে মুন্নার বাপের কাছ থেকেও কিছু প্রাপ্তির আশা। মনের মত কাজ হলে রাধু তো প্রতিশ্রুতির টাকা কড়া-ক্রান্তিতে গুনে দেবেই।
সেই বড় গুণীন প্রথমে খুব ঘটা করেই চেষ্টা করল প্রেত ছাড়াতে। তারপর তার মুখ ভয়াল গম্ভীর। মুন্নার বাপকে কাছে ডেকে জানালো, মুন্নার স্বামীর প্রেত ভর করেছে ওর ওপর–সে-ই তার বহুকে আগলে রেখেছে। বহুর সামনে পুরুষ মানুষ দেখলেই সেই প্রেত ক্ষেপে যায়। এই মেয়েকে যে বিয়ে করবে এখন ওই প্রেত তার ঘাড় মটকাবেই। এখন একমাত্র পথ মেয়ের জন্য ডেরার কাছাকাছি একটা আলাদা ঘর তুলে দেওয়া। সেদিকে কোনো পুরুষ মানুষ ঘেঁষবে না। আর রাতে পুরুষ বা মেয়ে কেউ না। ধরে নিতে হবে মেয়ে এখনো তার স্বামীর ঘর করছে।
মুন্নার বাপ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করেছে, কতদিন এভাবে চলবে?
বড় গুণীন জবাব দিয়েছে, এক বছর কি দুবছর কি তিন বছর কেউ বলতে পারবে না। মুন্না অর্থাৎ ওই প্রেতকে যত বিরক্ত করা হবে ততো অমঙ্গল। এক সময় সে নিজে থেকেই মুন্নাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে। পুরোপুরি যেদিন ছাড়বে, ওই প্রেত নিজেই তার ডেরার এক দিক ভেঙে দিয়ে চলে যাবে।
অবিশ্বাস কেউ করেনি, কারণ অবিশ্বাসের কোনো পথ মুন্না রাখেনি। মাস দেড় সে ঠাণ্ডাভাবে কাটালো, সন্ধ্যার পর কোনো পুরুষকে ঘরের কাছাকাছি দেখলে তখন। সে তার টুটি কামড়ে নিতে ছোটে। ওর বাপকেও ছেড়ে কথা কয় না।
তারপর থেকে ওদের নৈশ অভিসার ভালই চলছিল। বিশেষ করে কৃষ্ণপক্ষের আঁধার রাতে। অন্ধকারে মিশে মুন্না চলে যেত রাধুর ডেরায়–অনেকটা পথ, কিন্তু মুন্নার ভয় ডর কিছু ছিল না। ভোর হবার ঢের আগেই আবার ফিরে আসত। আর তখন থেকেই টাকা জমাবার চেষ্টায় মন দিয়েছে রাধু। হাতে কিছু জমলেই সকলের। চোখে ধুলো দিয়ে মুন্নাকে নিয়ে সে গ্রাম ছেড়ে পালাবে।
সুখেই দিন যাচ্ছিল।
..সব ওলট পালট হয়ে গেল ওই নয়া বাবা এসে এখানে সহস্রমুণ্ডীর আসন। পেতে বসতে। ওই ছোকরা সাধু যেন রাতারাতি বশ করে ফেলল ওকে। নিজের চোখে রাধু নয়া বাবার এমন সব তাজ্জব কাণ্ড দেখল যে মুন্না গোপনে তার ডেরায়। এলে ওর কাপুনি ধরে। মুন্নার আসাই একরকম বন্ধ করে দিল রাধু। ফলে মুন্না আবার। নয়া বাবার ওপর বিরূপ।
ওকে ঠাণ্ডা রাখার জন্যেও বটে আবার প্রবৃত্তির তাড়নায়ও বটে, এর থেকে ব্যবস্থাটা উল্টে গেল। সুযোগ পেলেই রাধুই রাতের আঁধারে মুন্নার ডেরায় যায়। না, ভয় ডর তখন ওরও লেশমাত্র নেই। অতবড় বাবার চেলা হয়ে বসেছে, ও ভয় করবে কাকে? ভয় একমাত্র ওই নয়া বাবাকেই। গোড়ায় গোড়ায় মুন্নার ডেরা থেকে রাতের শেষ প্রহরে বা তার আগেই কাঁপতে কাঁপতে ফিরত। কিন্তু ভয়টা ক্রমে ক্রমে কমে আসতে লাগল। মুন্নাকেও অন্যরকম আশ্বাস দেবার সুযোগ মিলল, ভক্তদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা খাবার-দাবারের ভেট যা আসে নয়া বাবা তো সেদিকে ফিরেও তাকায় না। অতএব টাকা আরো অনেক আগেই জমবে, আর ওদেরও পালানোর। সুবিধে হবে। মুন্নার জন্য ভালো ভালো খাবারও সঙ্গে নিয়ে যায় সে।
…কিন্তু মুন্নার প্রতি আকর্ষণ সত্ত্বেও এখান থেকে বাবাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছেটা যে ক্রমেই কমে আসছে, সে-কথা ওকে মুখ ফুটে বলতে পারে না।
দ্বিতীয় দফা গণ্ডগোলের ব্যাপার হয়ে গেল মহাশ্মশানে বামাসাধিকার পদার্পণের পর। সেই সঙ্গে রাধুর ভিতরটারও আর এক প্রস্থ ওলট পালট। মুন্নার কাছে যাওয়ার সুযোগ এর আগে থেকে কমে গেল। প্রবৃত্তির অন্ধ তাড়না যখন অসহ্য মনে হয় তখনি শুধু চোরের মতো চুপিচুপি যায়। কিন্তু এরই ফলে আবার মুন্নার সঙ্গে খটাখটি লাগে, ঝগড়া-ঝাটি হয়ে যায়। বেশি রাগলে মুন্না শাসায় ও-ই যাবে রাধুর ডেরায়, নয়া বাবা কেমন করে ওকে ঠেকাতে পারে দেখে নেবে!
ভয়ে ত্রাসে রাধু ওকে তখন কত ভাবে বোঝাতে চেষ্টা করে ঠিক নেই। ত্রাসের কারণও আছে, ইদানীং ও বাইরে রাত কাটালেই ঠিক ঠিক যেন বুঝতে পারে। এমন করে তাকায় তার দিকে যে রাধুর বুকের তলায় কম্প শুরু হয়। ও মনে মনে নাক কান মলে, আর কক্ষনো অমন কাজ করবে না–চুলোয় যাক মুন্না।
…আশ্চর্য, নয়া বাবা আর সেই সঙ্গে বামাসাধিকা ওকে যেমন বশ করেছে, তেমনি মুন্নার প্রতি টানটাও কিছুতে যেন ছেড়বার নয়। সেই অন্ধ তাড়না যখন ওকে পেয়ে বসে, তখন সব ভুল হয়ে যায়। নেশাগ্রস্তের মতই ও তখন না গিয়ে পারে না। ওদিকে মুন্নাও তেড়ে আসে, ওকে তাড়িয়ে দিতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাড়িয়ে দেয় না–বরং লোকটাকে দ্বিগুণ বশ করার নেশায় সে-ও ভিতরে ভিতরে ঝলসে ওঠে।
দুদিক থেকেই রাধুর নিগ্রহ বাড়তে থাকে। বাবা ঠিক টের পায়। তার ভ্রূকুটি আরো ভয়াল হয়। এক-একদিন এমন করে তাকায় যেন ভস্ম করে ফেলবে ওকে। তখন আবার মুন্নাকেই খুন করতে ইচ্ছে যায় রাধুর।
ব্যাপারটা মা জেনে ফেলার পর প্রথম দিনকতক খুব ভয়ে ভয়ে ছিল রাধু। কিন্তু বিপদ কিছু ঘটল না। তবু কিছুকাল নিজেকে সংযমের শেকলে বেঁধে রাখল রাধু। বেশি যাতনা শুরু হলে ডবল মদ খেয়ে জ্বালা জুড়োয়।…আশ্চর্য এই নেশা করলে নয়া বাবা কিন্তু ভুক্ষেপও করে না।