আসল অপরাধী যে, সে-পর্যন্ত এই দৃশ্য দেখে আর এই অভিসম্পাত শুনে ভয়ে কাঠ কয়েক মুহূর্ত। তারপর অবশ্য দরোয়ান দিয়ে ওই উন্মাদিনী আর তার ছেলের বউকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে।
সকলের বিশ্বাস, বিধবা মায়ের সেই অভিসম্পাত ওই রাত থেকেই ফলতে শুরু করেছে। কারণ, ছোট ভূস্বামীর সেই যে ধর্ম-পাগল ছেলেটা আর্তনাদ করে ঘর ছেড়ে ছুটে পালিয়েছিল তার সন্ধান আর মেলেনি। আসলে ছেলেটা বাড়ি থেকেই ছুটে বেরিয়ে গেছল। সমস্ত লোকের মনোযোগ সেই উন্মাদিনী মায়ের দিকে ছিল বলে। কেউ লক্ষ্য করেনি। কদিন ধরে দশ বিশখানা গ্রাম তোলপাড় করেও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পুত্রশোকাতুরা উন্মাদিনী বিধবা আর একটা দিনও সুস্থ হয়নি। যতদিন নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নিতে ফেলতে পেরেছে, ওই ভূস্বামীদের ওই এক অভিসম্পাত করে গেছে। তার পুত্রবধূ গরিব বাপের সেই রূপসী মেয়েও আধ-পাগল। কারো সঙ্গে একটি কথাও বলে না, দিবারাত্র কেবল হাতে করে নিজের কপাল মোছে। কিন্তু তার ধারণা কপাল থেকে রক্তের দাগ আর কিছুতে উঠছে না।
তিনমাস না যেতে বড় ভূস্বামীর সেই লম্পট ছেলের বাসনা এই রূপসী বউকে কেন্দ্র করে জ্বলে উঠতে শুরু করেছে। দিবারাত্র তাকে এই বাড়ির কাছাকাছি ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়। যে বউ সমস্তক্ষণ বোবা সে শুধু ওই লম্পটকে দেখলেই চেঁচিয়ে ওঠে, সময় ঘনিয়েছে, কাল ঘনিয়েছে, রোসো!
অবাক কাণ্ড, সত্যিই তার কাল ঘনালো। তিনদিন আগে মাত্র পুত্রশোকাতুরা সেই উন্মাদিনী মা হৃদরোগে আচমকা চোখ বুজেছেন। ঠিক তিনদিন বাদে খুব সকালে। দেখা গেছে বড় ভূস্বামীর সেই লম্পট ছেলের মৃতদেহ দুমাইল দুরের একটা পুকুরে ভাসছে। তার দুহাত দুপা শক্ত করে বাঁধা, মুখে কাপড় গোঁজা
অনেকেরই মনে মনে ধারণা ওই রূপসী বউয়ের স্বামীর অন্তরঙ্গ সঙ্গীদের কাজ এটা। এই নির্মম প্রতিশোধ তারাই নিয়েছে।
আর সেই রাতের পর থেকেই ওই রূপসী বউকে গাঁয়ের মানুষ আর দেখেনি। কোনদিনও দেখেনি।
মায়ের মুখে ওই অত্যাচারের গল্প শুনেই রাধু স্তব্ধ, কারণ তার অন্তরাত্মাসুদ্ধ বলে উঠেছে এই বামাসাধিকাই সেই রূপসী বউ। সঙ্গে সঙ্গে বকের ভিতরে কাঁপুনি। তার।…ওই নয়া বাবা তাহলে কে? ছোট ভূস্বামীর সেই ছেলে–কানে মন্ত্র দিয়ে সাধু ও যাকে অকালে ধর্মপাগল করে দিয়েছিল? যত ভেবেছে রাধুর কাপুনি বেড়েছে। বামাসাধিকা প্রথমদিন বেলা দ্বিপ্রহরে এই মহাশ্মশানে এসে যে-ভাবে দাঁড়িয়ে আসনে। সমাসীন বাবাকে দেখছিল–সেই দৃশ্য মনে পড়তেই কাঁপুনি বেড়েছিল। এমন অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল যে সেই প্রথম দেখা আগুন-পানা মেয়েছেলেকে পাগলই মনে হয়েছিল।…আর এখনো মা যে-ভাবে এক-একসময় বাবাকে দেখে চেয়ে চেয়ে। –তাও কেমন স্বাভাবিক মনে হয় না রাধুর।
ভয়ে ভয়ে এ-প্রসঙ্গ মায়ের কাছে আর কোনদিন তোলেনি রাধু। সে কেবলই ভাবতে চেষ্টা করেছে, আগের পরিচয় নিয়ে মাথা ঘামানো মিথ্যে–তাদের নয়া বাবা মহাযোগী, আর বামাসাধিকা মহাযোগিনী।
.
বিপদের সূত্রপাত রাধুকে নিয়েই। সে নিজেই স্বীকার করেছে তার স্বভাব চরিত্র ভালো ছিল না। ওর দুটো নেশা ছিল। মদ আর মুন্না। কিন্তু মুন্নাকে পেলে মদের দরকার হত না। শুধু ওই মেয়ের জন্যেই নদীর ধার ছেড়ে, সগোত্রদের ছেড়ে এই দূরে এসে ডেরা বেঁধেছিল সে। মহাশ্মশানের এই নির্জনে রাত-দুপুরে বিরক্ত করতে আসবে এত বুকের পাটা ওর স্বজাতীয়দেরও নেই।
শুধু মুন্নাই আসত। একেবারে নির্ভয়ে আসত। অমন বুকের পাটাও বোধহয় কোনো মেয়েমানুষের হয়না। মুন্নার বাপ মানুষটা যেমন ক্রুর তেমনি লোভী। রাধুকে সে দুচক্ষে দেখতে পারতনা। পারবে কেন, রাধু যে কোনদিন তার হুকুমের পরোয়া করত না-সর্বদা বুক চিতিয়ে চলত। আবার ঠিক সেই কারণে মুন্না ওকে সক্কলের থেকে বেশি পছন্দ করত। ওর চোখে রাধুই একমাত্র মরদ। মুন্নার গায়ের রং সামান্য তামাটে। আর ঘাগরা পরা চৌদ্দ বছরের সেই মেয়ের পাথরে কোঁদা নিটোল স্বাস্থ্য দেখলে পুরুষগুলোর চোখে ঘোর লাগত। তার ওপর গায়ের ওই রঙের বাড়তি কদর। ….ষোল বছর বয়সে একরাশ টাকা গুনে নিয়ে বাপ ওকে চুলের ঝুঁটি ধরে একটা বদমাসের হাতে সঁপে দিল। রাধু তখন মুন্নার বাপকে খুন করবে বলে শাসিয়েছিল–মাতব্বরকে এভাবে অপমান করার দরুন তাবেদার স্বজাতীয়রা ওকে প্রায় বর্জনই করেছিল।
দুবছর বাদে মুন্নার শয়তান স্বামীটাকে সাপে কাটতে মুন্নার হাড়ে বাতাস লেগেছিল। ওদিকে বাপও আবার মেয়ের ওপর দখল পেয়ে খুশি। আবার কারো কাছে মেয়ে বেচে মোটা দাও মারবে।
কিন্তু মেয়েও কম নয়, বাপের হাত থেকে বাঁচার রাস্তা সেই বার করল মাথা। খাঁটিয়ে। ওর ওপর প্রেত ভর করল। ভর যে করবে রাধুকে ও সেটা আগেই জানিয়ে রেখেছিল। সারাক্ষণ আলুথালু বিকট মূর্তি মুন্নার কোনো পুরুষ মানুষ কাছে আসতে চাইলেই সে তাকে মারতে ছোটে। নেচে কুঁদে একাকার কাণ্ড করে। চার পাঁচটা জোয়ান মানুষও তখন ধরে রাখতে পারে না ওকে।
মুন্নার বাপও ঘাবড়ে গেল। দুতিনটে ওঝা প্রেত ছাড়াতে এসে উল্টে নাজেহাল হয়ে ফিরে গেল। অবশ্য মুন্নারও হেনস্থা কম হলনা। ঝাটার পিটুনি খেয়ে তার সর্বাঙ্গ দাগড়া হয়ে গেল। মার খেয়ে ঝিম মেরে থাকে, আবার ফঁক পেলেই ওই গুণীনদের। টুটি কামড়ে ধরতে আসে। এক গুণীনের তো প্রাণান্ত দশাই করে ছেড়েছিল।