আবার সেই একই প্রশ্ন করলাম আমি, এবারে ভেবে বলো–যা হয়েছে সব তোমার জন্যেই হয়েছে? আর কোনো কারণ নেই? এ-কথা তুমি তোমার ওই মায়ের নামে শপথ করে বলতে পারো?
অনেকক্ষণ বাদে রাধু ভৃঙ্গী আস্তে আস্তে মাথা নেড়েছে। বলতে পারে না। মর্মছেঁড়া সত্যি কবুল করার মতো করে যা বলল তার সারমর্ম, ওই নয়া বাবার ওপর বামাসাধিকা প্রতিশোধ নিয়েছে, পুরনো হিংসার মোকাবিলা করেছে..রাধু সেটা আগে বুঝতে পারেনি, সব শেষ হয়ে যাবার পরে বুঝেছে। কিন্তু তবু সব কিছুর জন্য রাধু নিজেকে দায়ী করে কারণ সমস্ত সর্বনাশের সে উপলক্ষ–ওর আর মুন্নির জন্যই শেষ পর্যন্ত সাধিকার শিরার রক্তে পুরনো হিংসার আগুন জ্বলল…নইলে সাধিকা সেটা ভুলতে চেষ্টা করেছিল, ভুলতে চেয়েছিল, নয়া বাবার সেবা করে হিংসা ক্ষয় করতে চেয়েছিল, ক্ষয় করছিল।
.
শ্রী মুখোপাধ্যায়ের মুখে শোনা কাহিনীর কাঠামোর সঙ্গে এবারে মিলছে। প্রতিশোধের নেশা কেমন করে রক্তের সঙ্গে মিশে থাকতে পারে সেই আলোচনার প্রসঙ্গ থেকেই তাঁর এই কাহিনীর সূত্রপাত। কাহিনীটা নিজের কাছেই অসম্পূর্ণ মনে হয়েছিল শ্রী মুখোপাধ্যায়ের। কারণ সেখানে রাধু ভূদীর ভূমিকাটি অনুপস্থিত ছিল। কিন্তু রোমহর্ষক সেই সংঘাতে রাধুর সেই ভূমিকা প্রায় অবিচ্ছেদ্য বলা যেতে পারে।
…রাধু ভৃঙ্গীকে যুক্ত করে শ্রী মুখোপাধ্যায়ের কাহিনীর চিত্রটি এবারে সম্পূর্ণ করা যেতে পারে।
…মহাশ্মশানের সেই মুখর দিনে নতুন বাবা আশপাশের দশ গাঁয়ের মানুষের হৃদয় মন জয় করে বসেছিল বললেও বেশি বলা হবে না। ওই বয়সের অমন নির্লোভ স্থিতধী তাপস আর বুঝি দেখেনি কেউ। আর এক বছর যেতে অমন তাপসের কিনা গার্জেন হয়ে বসল বামাসাধিকা। তার কি শক্তি কম? গাঁয়ের মানুষেরা আদ্যাশক্তির জাগ্রত অংশ ভাবত তাকে। সব থেকে বেশি ভাবত রাধু নিজে।
শ্মশানগত ভক্তদের কাছে বামাসাধিকা মায়ের মতই সরল তরল, অন্য দিকে অগ্নিস্তব্ধ তেজের জীবন্ত প্রতিমূর্তি। রাধুর এক-একসময় মনে হত ওই মায়ের কল্যাণেই হয়ত সমস্ত দেশের মানুষ একদিন এই মহাশ্মশানে এসে নয়া বাবার পায়ে ধন্না দেবে। মায়ের এমনি তেজ এমনি আকর্ষণীয় শক্তি।
ভাবের আবেগে কথায় কথায় রাধু মা-কে একদিন সে-কথা বলেও ফেলেছিল। শুনে বামাসাধিকা হেসে বাঁচে না। বলেছিল, তোর মহাদেও বাবা তো ওই অশ্বথ গাছটার মতো একটা কাঠের গুঁড়ি–গাছটা তবু ডালপালা ছড়ায় ছায়া দেয়, তোর বাবার কাছে এসে ধন্না দিয়ে কে কি পাবে?
রাধু রাগ করে পাল্টা জবাব দিয়েছিল, যার ভাগ্যে আছে সে পাবে–তুমি পাচ্ছ। কি পাচ্ছ না?
ও-কথা শুনেও মায়ের সেকি হাসি। তারপর বলেছিল, আমি পেতে এসেছি তোকে কে বলল রে?
শুনে রাধু থতমত খেয়েছিল। মনে হয়েছিল সাধিকা মা হয়তো বাবাকে প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে যেতেই এসেছে এখানে।
কিন্তু বাবাকে কাঠের গুঁড়ি বললেও তার ওপর বামাসাধিকার প্রতিপত্তি কিন্তু দিব্যি বাড়ছিল। নয়া বাবা সহস্রমুণ্ডীর আসনে সাধনায় বসে থাকে যতক্ষণ, ততক্ষণ অবশ্য কাঠের গুঁড়িই বসে। নিশ্চল দেহটা শুধু আসনে বসে থাকে, তিনি যে কোথায় চলে যান কে জানে। কিন্তু অন্য সময় বাবার ওপর মায়ের শাসন আর হম্বিতম্বি লেগেই আছে। বয়সে অবশ্য নয়া বাবা মায়ের থেকে চার বছরের ছোট কিন্তু অমন মহাযোগীকে কে আর বয়েস দিয়ে বিচার করে? কিন্তু মায়ের কাছে বাবা যেন ছোট্ট ছেলে একটা, যেমন করে খুশি নাড়বে-চাড়বে খাওয়াবে বসাবে ঘুম পাড়াবে। কথার অবাধ্য হলে রাগে আর তেজে বাবাকে যেন ভস্ম করে ফেলবে একেবারে। মায়ের সেই রাগ আর সেই তেজ আর সেই ধক-ধকে চাউনি দেখে রাধুর কতদিন যে হৃৎকম্প হয়েছে ঠিক নেই। আর কি নিয়ে যে মা হঠাৎ বাবার ওপর রেগে যেত রাধু বেশিরভাগ সময় তাও ঠাওর করে উঠতে পারত না।
..বাবা যখন তার আসনে ধ্যানে বসে তখন মায়ের মুখ সেলাই একেবারে। এক একদিন এমন করে চেয়ে থাকত দূরে বসে যে রাধুর অবাক লাগত। কত দিন দেখেছে, মায়ের চোখে পলক পড়ে না, চেয়েই আছে চেয়েই আছে। সে এক অদ্ভুত চাউনি।
রাধু কতদিন জিজ্ঞেস করেছে, বাবার দিকে চেয়ে চেয়ে তুমি কি দেখ?।
মা বেশিরভাগ দিনই হেসেছে, কিন্তু একদিন জবাব দিয়েছিল, বলেছিল, দেখে দেখে নিজের বুকের তলায় আগুন নেভাই রে-নেভাতে চেষ্টা করি কিন্তু সে কি সহজে নেভে রে!
রাধু চমকে উঠেছিল! অস্বস্তির একশেষ তারপর।…মা কোন আগুনের কথা বলছে? বাসনার আগুন? তক্ষুনি সরোষে নিজের কান মলেছে নাক মলেছে রাধু। হয়তো ভগবান দেখার বাসনা মায়ের, তাকে না দেখতে পেয়ে মায়ের বুক জ্বলছে–তাই মানুষের মধ্যে ভগবানকে দেখে মা জ্বালা জুড়োয়। তাই হবে, তাছাড়া আর কি হতে পারে।
একরাতে রাধুর জ্বর হয়েছিল বেশ। এই শরীরে জ্বরজ্বলা হত না বড়, তাই একটু কাহিল হয়ে পড়েছিল। ঘর ছেড়ে বেরোয়নি। রাত্রিতে বামাসাধিকা এলো ওকে দেখতে। মাথায় গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। রাধুর মনে হচ্ছিল সাক্ষাৎ দেবী এসে। ওর জ্বালা যন্ত্রণা দূর করে দিচ্ছে।
সেই উন্মাদিনী বিধবা মা তাই দেখে বীভৎসভাবে হেসে উঠল, ও বুঝেছে ওদের সক্কলকে খাব আমরা, তাই পালালো–কিন্তু যাবে কোথায়, কেউ রক্ষা পাবে না, আমাদের হাত থেকে কারো নিস্তার নেই!