- বইয়ের নামঃ মীনা রাখি সাধিকা
- লেখকের নামঃ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃগল্পের বই
সাধিকা
ভর দুপুরে সত্যিই আমাকে অত দূরের মহাশ্মশানের দিকে পা বাড়ানোর জন্য প্রস্তুত হতে দেখে সুরসিক শ্রী মুখোপাধ্যায় ফাঁপরে পড়লেন যেন। অনেকটা নিজের ওপরেই দোষারোপ করে বললেন, পাগলকে সাঁকো নাড়তে নিষেধ করে মুশকিলে পড়া গেল দেখি! তাছাড়া আজও সে ব্যাটা বেঁচে আছে কিনা ঠিক কি, কতকাল আর ও-পথ মাড়াইওনি দেখিওনি ওকে
ঝোলাটা কাঁধে ফেলতে ফেলতে বললাম, লেটেস্ট খবরটা আমিই আপনাকে দিতে পারব তাহলে, দেখে আসি
শ্রী মুখোপাধ্যায়ের অনুরাগী পাশের প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি আমার কানে কানে বললেন, কাঁধে আবার ঝোলা কেন, রাধু ভৃঙ্গীর হৃদয় জয় করার কিছু রসদটসদও সঙ্গে নিলেন নাকি?
হেসে জবাব দিলাম, না, ওটা আমার পর্যটন-সঙ্গী…তবে আগে জানলে ভাবতাম।
সাদা কথায় ঝোলাতে সুরার বোতল-টোতল কিছু আছে কিনা সেই ঠাট্টা করেছেন তিনি। শ্রী মুখোপাধ্যায়ও সেটা বুঝেছেন, কিন্তু সেদিকে কান না দিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে আমার খেয়ালটা নাকচ করতে চাইলেন তিনি। বললেন, আরে বাবা সে কি এখানে, যেতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে, কি ফ্যাসাদে পড়ো ঠিক আছে, যে দিন-কাল পড়েছে।
এই স্থানে আমার পদার্পণও এক আকস্মিক খেয়ালের ব্যাপার বললে অত্যুক্তি হবে না। এসেছিলাম শান্তিনিকেতনের পৌষ উৎসবে। বয়সের দোষে চোখের প্রসাদ আর নিভৃতের বর্ণবৈচিত্র্য কতটা খোয়া গেছে জানি না, বহুবারের দেখা এই উৎসবের সবটাই ছকে বাঁধা আনুষ্ঠানিক মনে হচ্ছিল। আসল কথা, কবি-গুরুর চিরকিশোর রসের কারিগরটি যে কারণেই হোক আমার মধ্যে যে একেবারে অনুপস্থিত সেটাই অনুভব করছিলাম। দুদিনেই হাঁপ ধরে গেছল, অথচ হাতে ঢালা অবকাশ।
ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে পড়েছিলাম। স্টেশনে এসে এই লাইনের একেবারে শেষ মাথার এক জায়গার টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে বসেছি। সেখানে আমার এক আত্মীয় থাকেন, দিনকতক তার কাছে কাটিয়ে আসা যাবে।
কিন্তু টিকিট যেখানকারই কাটি, সেটাই যে গন্তব্যস্থান হবে তার কি মানে! মোটকথা আমার গন্তব্যস্থান আমি নিজেই জানতুম না। দিগন্তছোঁয়া ধানকাটা শুকনো মাঠ আর শীতের শুকনো খাল-বিল দেখতে দেখতে দুচোখ ক্লান্ত। দিবানিদ্রার অভ্যেস নেই তবু ঝিমুনি এসে গেছল।
শীতের ছোট বেলা পড়-পড় তখন। এক জায়গায় ট্রেনটা থামতে চোখ মেলে আর তারপর জানলায় ঝুঁকে স্টেশনের নামটা দেখে নিতে গেলাম।
যোগাযোগ বলতে হবে। সেই মুহূর্তে আমার গন্তব্যস্থল বদলে গেল। স্টেশনের নামটাই হঠাৎ যেন আমাকে ঘাড় ধরে টেনে নামাতে চাইল। ট্রেন বড়জোর এক মিনিট দাঁড়াবে, তার মধ্যে আধ মিনিট কাবার। ঝোলাটা টেনে নিয়ে ব্যস্ত সমস্তভাবে দরজার দিকে এগোলাম। পাশের যে বয়স্ক ভদ্রলোকটির সঙ্গে ঘণ্টাখানেক আগেও গল্প করছিলাম, আমার কাণ্ড দেখে তিনি হাঁ। কারণ আমার গন্তব্যস্থান কোথায় সহযাত্রীর স্বভাবগত কৌতূহলে আগেই তিনি জেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু তার বিস্ময় নিরসনের আর সময় ছিল না। গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামতেই জানলা দিয়ে ঝুঁকে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, ও মশাই আপনি এখানে নামলেন যে?
জবাবদিহি করলাম, এখানে একজনের কথা মনে পড়ে গেল তাই
এতক্ষণ কোনো পাগলের পাল্লায় পড়েছিলেন কিনা ভদ্রলোকের দুই গোল চোখে সেই সংশয়। ওদিকে গাড়ি ততক্ষণে আবার নড়েছে। ভদ্রলোক তখনো জানলায় ঝুঁকে আছেন। তাঁর মুখখানা দেখে কৌতুক বোধ করেছিলাম বলেই সেই মুখ দৃষ্টির আড়াল না হওয়া পর্যন্ত আমি দাঁড়িয়েই রইলাম।
প্ল্যাটফরম ততক্ষণে ফাঁকা। অল্প কয়েকজন লোক মাত্র নামা-ওঠা করেছে। আমি যখন বেরুলাম টিকিটটা নেবার জন্য গেটে চেকারও দাঁড়িয়ে নেই।
স্টেশন থেকে নেমে মাটিতে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে গোটাচারেক সাইকেল-রিকশা একসঙ্গে যেন তেড়ে এলো আমার দিকে। মিলিত গলায় ডাকাডাকি রেষারিষি। সেই মুহূর্তের মধ্যেই মনস্থির করে ওদের সকলের উদ্দেশ্যেই মাথা নেড়ে সামনের নাক বরাবর একটি মাত্র সোজা রাস্তায় পা বাড়ালাম। দুদিকে ধানী জমির মাঝখান দিয়ে লাল মাটির উঁচু রাস্তা কম করে মাইলখানেক প্রায় সোজাই চলে গেছে। পথ হারাবার বা ভুলচুক করার সম্ভাবনা নেই। তারপর গাঁয়ে পা দিলে যাইে জিজ্ঞাসা করব সেই শ্রী মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির হদিস বাতলে দেবে। এক বছরও হয়নি শ্রী মুখোপাধ্যায় নিজেই আমাকে বলেছিলেন, স্টেশন থেকে সাইকেল রিকশয় উঠে আমার নাম কোরো, সে সোজা আমার বাড়িতে দরজায় এনে নামিয়ে দেবে তোমাকে। আর গায়ে পা দিয়ে যাকে জিজ্ঞেস করবে সে-ই বলে দেবে।–
বলা বাহুল্য যে বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির বাড়িতে ধূমকেতুর মতো আমি গিয়ে হাজির হতে চলেছি, ট্রেন থেকে স্টেশনের নাম দেখামাত্র এই শ্ৰী মুখোপাধ্যায়ের হাসি-খুশি মুখখানাই আমার মনে পড়েছে। শ্রী মুখোপাধ্যায়ের নামটা অনুক্ত রাখার কারণ, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আর তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের তালিকায় অন্তত ওটা সুপরিচিত নাম। তাঁর অনেক রচনা স্নাতক-পাঠ্য। তাছাড়া তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ বলতে কোনো খটমট বস্তু তাঁর গবেষণার বিষয় নয়, উল্টে বরং রসতত্ত্বের কারবারী হিসেবে তার সুনাম আছে। মোট কথা বিদগ্ধ জনের কাছে তিনি জ্ঞানী এবং গুণী হিসেবে শুধু সুপরিচিত নয়, বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্রও। তাই কাহিনীর মধ্যে সরাসরি তার নামটা টেনে আনতে আপত্তি। আপত্তি আমার থেকেও তার বেশি। আসার আগে হাসিমাখা সস্নেহ অনুযোগে বলেছিলেন, বাড়ি গিয়ে এরপর কি করবে বুঝতেই পারছি, যাই করো তাই করো তোমাদের ওই গাঁজার চমকের মধ্যে আমার হাতেই যেন কল্কেটি চাপিয়ে দিও না।